ইট ভাটায় স্বপ্ন বুঁনছে কিশোর

কিশোর মারুফ কায়সার (১৬) স্বপ্ন দেখে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়ার। কিন্তু পরিবারের অভাব-অনটনে তার শৈশব জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়। বাবা একজন ভ্যানচালক হওয়ায় অভাব যেন মারুফের জীবনে নিত্য দিনের সঙ্গী। সে পারে না পড়াশুনার ফাঁকে অন্যদের মতো হইহুল্লোড় করে ছোটাছুটি করতে।

করোনায় স্কুল বন্ধ হওয়ায় নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে এই কিশোর বেছে নেয় ইটভাটায় কাজ।আর এখন ইটেই যেন স্বপ্ন বুঁনছে মারুফ। কাজ করে টাকা জমিয়ে সাইকেল কিনবে মারুফ। বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড় করে সাইকেলের প্যাডেল মেরে স্কুলে যাবে।

এই কিশোর মারুফ কায়সার (১৬) সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নের দক্ষিণ বঠিনা গ্রামের বাদল হোসেনের ছেলে। বুধবার (১০ ফেব্রুয়ারি বিকেলে সদর উপজেলার আকচার একটি ইটভাটায় গেলে এমনই কথা হয় মারুফের সঙ্গে। মারুফ কায়সার পুরাতন ঠাকুরগাঁওয়ে একটি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়াশুনা করত। তার বাবা একজন ভ্যানচালক। হঠাৎ করোনা মহামারির কারণে অর্থাভাবে তাদের পরিবারের আয়-রোজগার কমে যায়। কিন্তু অর্থের অভাবে মারুফের স্বপ্ন দেখা থামেনি। দারিদ্র্যের কষাঘাতে ইটভাটায় সারিতে সারিতে সাজানো কাঁচা ইট তৈরিতে নেমেছে সে।

মাটি দিয়ে ইটের বক্সের মতো করে আকার দিয়ে ইট তৈরিতে ব্যস্ত কিশোর মারুফ। এই কাজের জন্য হাতে-পায়ে কাদা লাগিয়ে কঠোর পরিশ্রম করছে সে। আজ নিজের স্বপ্নের কথা বলেন মারুফ।

সে জানায়, ‘যখন স্কুলে যেতাম সবসময় দেখতাম আমার বন্ধুরা সুন্দর সাইকেল নিয়ে স্কুলে যাইতো, কিন্তু আমাকে যেতে হতো হেঁটে হেঁটে। প্রতিদিন এটা নিয়ে মন খারাপ থাকতো। কিন্তু করার ছিল না কিছুই। কারণ আমি জানি, বাবা একজন গরিব ভ্যানচালক। ছোটো আরও দুই ভাই আছে আমার। তারা পড়াশুনা করে। আমি সবার বড়। সংসার চালাতে যেখানে আমার বাবাকে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে আমার জন্য সাইকেল কেনা বা পড়াশুনার খরচ দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই আমার বাবার। যখন আমার বন্ধুরা আমার সামনে দিয়ে সাইকেল নিয়ে চলে যায় তখনই আমার মনে এটা স্বপ্ন জাগে। একদিন আমিও নেব একটি ভালো সাইকেল। সাইকেলে প্যাডেল দিয়ে ভোঁ-ভোঁ করে আমিও তাদের সঙ্গে যাব স্কুলে। এমনই স্বপ্ন নিয়েই প্রতি রাতে ঘুমাতে হতো আমাকে।’

মারুফ জানায়, ‘একটা সময় এই ইটভাটায় আমার মা খাবার রান্না করতো। সেই সময় আমি আমার মায়ের সঙ্গে আসতাম, দেখতাম কীভাবে করে ইট বানাতে হয়। এরপর আমি আমার মাকে একাধিকবার বলেছিলাম এখানে আমাকে কাজ করতে দিতে, কিন্তু তিনি রাজি হননি। শেষে সবাইকে বুঝিয়ে, স্বেচ্ছায় ইটভাটায় কাজ করতে এসেছি। প্রথমের দিকে কিছুটা কাজ কম পারতাম, কিন্তু এখন অনেক কাজ শিখেছি। এখানে সারাদিন কাজ করলে ৩০০ টাকা করে দেয়। দৈনিক প্রায় এক হাজারের মতো ইট তৈরি করি আমি।’

মারুফের মা মিনারা বেগম বলেন, ‘অনেকবার মারুফকে বারণ করা হয়েছে। কিন্তু সে কারও কথা না শুনে এখানে কাজ নিয়েছে। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে কেন এই বয়সে টাকা দরকার, তখনই সে তার স্বপ্নের কথা বলে। কারণ এই অল্প বয়সে সে আমাদের পরিবারের কষ্টের বিষয়টি বুঝেছে। আমার স্বামী একজন সামান্য ভ্যানচালক। তার আয় দিয়ে সংসার চালানোই কষ্টকর। সেখানে ছেলের স্বপ্ন কী করে পূরণ করবো।’

এই ব্রিকস ভাটার ম্যানেজার জানান, ‘একটা সময় মারুফের মা আমাদের এই ভাটায় রান্না করার কাজ করতো। এরপর সে চলে যায়। পরে একদিন এই মারুফ আমার রুমে এসে বলে আমি কাজ করবো ইট বানানোর। যেহেতু ভাটায় কোনো শিশুর কাজ করার নিয়ম নেই, সেই কারণে আমি তাকে বারণ করে দেই। এরপর সে প্রতিনিয়ত আমাদের ভাটায় এসে ঘোরাঘুরি করে এবং আমাকে বলে কাজ দেন। পরে আমি তাকে পুনরায় বারণ করলে সে কেঁদে ফেলে। এ সময় আমি তাকে আমার রুমে নিয়ে গিয়ে বোঝানোর সময় সে বলে আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য আমি আপনার এখানে কাজ করতে চাই। তার মুখে সব শুনে আমি তাকে কাজ দেই।’

মনিরুজ্জামান মিলন/বার্তাবাজার/এসজে

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর