যান্ত্রিক জীবনের ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে শিশু-কিশোরদের দূরন্তপনা

গ্রামের শিশু-কিশোরদের দূরন্তপনার এই দৃশ্যটি সত্যিই অভাবনীয় একটি দৃশ্য। ছোটবেলার অনেক কথায় মনে পড়ে যায় এমন দৃশ্য দেখে!ছবিটা সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ব্রম্মগাছা ইউনিয়নের জাঁনকিগাতী গ্রাম থেকে তোলা। ছবিটি দেখে বুঝতে বাকি নেই ওদের কিশোর জীবনের চঞ্চলতা কতটা উচুতে উঠতে পারে।

গ্রামবাংলার একটি দৃশ্য যা ক্রমাগত বিরল রুপ নিতে শুরু। নিছক দৌড়ে পথচলা নয় এটি। এতে তাদের চঞ্চল জীবনের গতির চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। এখন আর এমন চঞ্চলমনা কিশোর দেখতে পাওয়া যায় না। হারিয়ে গেছে ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের ভিড়ে।

মাঠে বন্ধুরা মিলে চড়ুই ভাতি করা, পাকা ফল গাছ থেকে পেড়ে মাঠে সবে খাওয়া, গাছ থেকে নারিকেল পেড়ে খাওয়া, আম-জাম ইত্যাদি ফল পেড়ে ভর্তা করে খাওয়া, তালের শাঁস বের করে খাওয়া গ্রামের এসব আনন্দময় দৃশ্য বিলুপ্ত প্রায়। বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে ফুটবল খেলা, কখনো বা বাতাবি লেবু দিয়ে ফুটবল খেলা, বাঁশের গুড়ালি দিয়ে ব্যাট বানিয়ে ক্রিকেট খেলা, কানা মাছি, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, হা-ডু-ডু খেলা, আমের আঁটি দিয়ে খেলা, কাঠালে বীজ দিয়ে খেলা! সবই এখন অনেকটা স্মৃতি হয়ে আছে। সবই এখনকার গ্রামের ছেলেদের কাছে অনেকটা রূপকথার মতো।

দলবেধে নদীতে সাঁতার কাটার দৃশ্য অনেকটা বিরল। বৌ চোর খেলার মজা এ সময়ের ক’জনই বা বলতে পারবে? স্কুলে পলান টুকটুক খেলার আনন্দটাই ছিল আলাদা যা আজকাল পরীক্ষার চাপে বিলুপ্ত হয়েছে। শিশু-কিশোরদের জীবনের চঞ্চলময় গতি কেড়ে নিয়েছে এই পরীক্ষা। স্কুল, কোচিং আর পরীক্ষার চাপে তাদের জীবনে আনন্দ সোনার হরিণ হয়ে গেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনটাও কেড়ে নিয়েছে কোচিং।

বর্ষা এলে নতুন পানিতে মাছ ধরার জন্য বাজার থেকে ছোট জাল কিনে এনে দলবেধে মাছ ধরার দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে খুবই স্মৃতিকাতর হই আর ভাবি যদি একবার ফিরে আসতো সেই দিন তাহলে আর যেতে দিতাম না!

নগরেও যান্ত্রিক জীবনের ছোঁয়া লেগেছে গ্রামেও। দূরন্ত কিশোর বন্দি হয়ে গেছে আধুনিকতার নামে যন্ত্রের মাঝে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচলী’ উপন্যাসের অপু আর দূর্গা চরিত্র আছে কি বাংলার গ্রামে? অপু আর দূর্গার বেড়ে ওঠা যেনো প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা। তারা যেনো প্রকৃতির সন্তান। অপু আর দূর্গা তো গ্রাম বাংলার পাড়া গাঁয়ের কিশোরের প্রতিনিধিত্ব করেছে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’তে।

সকালের সূর্যোদয়ের এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করতে পারে কত জন ভাগ্যবান কিশোর? উচু স্থাপনার আড়ালে ঢেকে গেলে সোনালী প্রভাতের আলো, আড়াল হয়ে গেছে রং ছড়ানো সূর্যাস্তের দৃশ্য।

কার্তিক মাসের শেষে অগ্রাহায়ণ মাসের পহেলা তারিখে মশাল নিয়ে মশা-মাছির পোড়ানোর দৃশ্য অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে গ্রামের সমাজ থেকে। কত আনন্দই না হতো সেদিন। তা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। গ্রামের লোকনাট্য, গ্রাম্য পালাগান, বয়াতির গীতি, বৌ বন্দকের জারি গান গ্রামের এই সাংস্কৃতিক এখন আমাবশ্যার চাঁদ হয়ে গেছে! কোথাও আর শোনা যায় না ঢাকের শব্দ। পালাগানের দৃশ্য আর চোখে পড়ে না।

খুব মনে পড়ে বর্ষায় সবাই মিলে নৌকাতে পিকনিক করার কথা। উজান থেকে নৌকা ভাসিয়ে লুড্ডু খেলা শুরু করে বাটিতে যাওয়ার দৃশ্য কতটা উপভোগ্য তা যে ভেসেছে সেই জানে। প্লাবিত গ্রাম দেখে মনে হতো সবই যেনো ভাসমান। ভাসমান ছোট্ট বাড়ি দেখার নয়নাভিরাম দৃশ্য কতটা উপভোগ্য সে চিত্রকল্পা প্রকাশে আমি অক্ষম। বাড়ির উঠোনের এক কোনায় ধান লাগিয়ে তা ঘরে তোলার স্বপ্ন তো গ্রামের শিশুর প্রতি ধানি মৌসমের।

জানি না সে স্বপ্ন আজো লালন হয় কিনা কোন শিশুর মনে। আয়োজন করে মাঝে মাঝে মাইক বাড়া করে এনে সবাই মিলে গান বাজানোর আনন্দ উপভোগ এখনকার সময়ে অনেকটা হাস্যকর। কি আনন্দময় জীবন সেটা কেউ বুঝবে না যদি কখনো উপভোগ না করে থাকে। খুব মনে পড়ে মেজু কাকা যখন ছুটিতে গ্রামে আসতো তখন কাকাতো ভাই আর আমরা সবাই মিলে কি আনন্দই না করতাম! সারা রাত কেটে যেতো গল্পে। পরের দিনে কী করবো তার নিঘন্টা ঠিক করতে করতে ঘুমানোর সময় আর কোথায় পেতাম? এখন ১০ বছর পরে দেখা হলেও আর সে আনন্দ থাকে না। ইলেকট্রনিক ডিভাইসের স্কিন তা কেড়ে নিয়েছে।

এই আশা রাখি ফিরে আসুক সেই সজীবতা, চঞ্চলতা। আমরা মুক্তি পাই যান্ত্রিক জীবনের অভিশাপ থেকে। তবে হ্যা আমাদের প্রযুক্তির দরকার আছে, সেটা যেনো আমাদের স্বাভাবিক জীবনের গতিরোধক না হয়। প্রকৃতির অপার আনন্দ উপভোগের অংশ যেনো হারিয়ে না যায় যান্ত্রিকতার ভিড়ে। আমদের শিশু-কিশোররা যেনো তাদের আনন্দময় জীবনটাকে বিষাদময় না মনে করে। কেউ যেনো না ভাবে আমি জন্মে ভুল করেছি।

আমি স্রষ্টাকে ধন্যবাদ দেই, কৃতজ্ঞতা জানাই তিনি আমাকে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন বলেই আমি প্রকৃতির এতো কিছু দেখতে পেরেছি, উপভোগ করতে পেরেছি জীবনকে প্রকৃতির মাঝে। এখনো করে চলছি, করবো যতো দিন আছি এই সুন্দর পৃথিবীতে। জন্মের পর থেকে একটা কিশোর অন্তত ১০ বছর যেনো আনন্দময়, উপভোগ্য জীবন পায় এটাই আমার কামনা।

এটা তার খেলবার বয়স, উপভোগের বয়স, তার চঞ্চলতায় সে উৎফুল্ল মনে ছাপিয়ে যাবে গ্রাম, শহর, নগর, বন্দর। তাকে যেনো বন্দি না করে দেই কথিত বিদ্যাগারে। সে যেনো মনে না করে শিক্ষাটা তার জীবনের জন্য অভিশাপ। সে যেনো পড়া-লেখাকে আনন্দের বিষয় হিসেবে পড়ে। কারণ আনন্দময় মুহূর্তে কখনো মন থেকে মুছে যায় না। ভুলে না মানব মন, চিরদিন থাকে অম্লান।

যে বয়সটা আনন্দের সেটা নিরানন্দ করে দিচ্ছি কথিত বিদ্যার ঝুড়ি দিয়ে। কোমল মনে শিশু ছোট থেকে হয়ে উঠছে মনমরা। রসময় জীবন হয়ে উঠেছে বিষাদের খনি। সে তো কোন অন্যায় করেনি তাই আমি প্রত্যেক অভিভাবকের কাছে বলি, আমি অনুরোধ করি তাদেরকে এতো বড় শাস্তি দিবেন না। তাকে আনন্দ করতে দিন এই উপভোগের বয়সটাকে তার নিজের মতো করে উপভোগ করতে দিন। শুধু এতো টুকু খেয়াল রাখবেন যেনো আগুনে হাত না দেয়। অনুরোধ করবো ওদের বেধে রাখবেন না ছেড়ে দিন মুক্ত বিহঙ্গে ওড়বে ওদের কোমল মনের ভাবনাগুলো। বিকশিত হবে, তার আত্মদর্শন ছড়াবে আলো। ওদের খেলাঘর বানাতে দিন।

আমি অনুরোধ করবো সবার কাছে। বিশেষ করে যারা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক তাদের কাছে যে, একটা শিশু কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার জীবন যেনো বিষাদময় না হয়, যেনো ভালবাসা, আনন্দ হারিয়ে না যায় সে দিকে খেয়াল রেখে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করবেন। অভিভাবকদের কাছে বিশেষ করে মায়েদের কাছে অনুরোধ করবো আপনার প্রিয় সন্তানের আনন্দময়, ভালবাসাপূর্ণ জীবনটাকে তাকে উপভোগ করতে দিন। ছেড়ে দিন প্রকৃতির কোলে। কবি বন্দে আলী মিয়া’র ‘আমাদের গ্রাম’ কবিতায় গ্রামকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করার রুপকল্পের বাস্তব চিত্র দেখতে পাবেন আপনার সন্তানের মাঝে। ফিরে আসুক শিশুর জীবনে সজীবতা। আবার জেগে উঠুক চঞ্চলতা। চঞ্চল কিশোরের কোলাহল জাগিয়ে দিক সবার মনের তারূণ্যকে।

বার্তাবাজার/এমকে

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর