চাঁদাবাজি বন্ধ চান হিজড়ারাও

ডেস্ক রিপোর্ট: এ বছরের প্রথম সাড়ে ৪ মাসে সারাদেশে হিজড়াদের চাঁদাবাজি (তাদের ভাষায় ‘তোলা’) থেকে বাঁচতে পুলিশের সহায়তা নিয়েছেন ৬০২ জন। পুলিশের হস্তক্ষেপে অধিকাংশ ভুক্তভোগী রক্ষা পেলেও কয়েকটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। হিজড়াদের চাঁদাবাজি থেকে বাঁচতে ঢাকা মহানগরের সবচেয়ে বেশি ৪২১ জন পুলিশের শরণাপন্ন হন। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে হিজড়া সংগঠনের নেতারাও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৫ মে পর্যন্ত জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ নম্বরে এই হিসাব সংরক্ষিত রয়েছে। চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেছে হিজড়াদের সংগঠনগুলো। এসব সংগঠনের একাধিক নেতা দাবি করেন, তারা মাসিক ‘তোলা’ তুললেও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নন। প্রকৃত হিজড়ারা চাঁদাবাজি করেন না বলে দাবি তাদের।

জাতীয় জরুরি সেবার কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিন দেশের কোনও না কোনও প্রান্ত থেকে হিজড়াদের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ ফোন দেয়। তখন সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে ঘটনাস্থলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তথ্য বলছে, পুলিশের সহায়তা নেওয়া এই ৬০২ জনের মধ্যে ৪৯৩ জন দোকান, ব্যাংক ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি ১০৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন বাসাবাড়িতে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিজড়াদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশকে সতর্ক থাকতে হয়। কাউকে থানায় নেওয়া হলে হিজাড়ারা দল বেঁধে থানায় হাজির হয়ে উপদ্রব শুরু করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশ অনুরোধ করে বা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাদের সামলে থাকে। আক্রমণাত্মক হলেই কেবল পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে তাদের গুরু মায়ের কাছে থেকে মুচলেকা নিয়ে ছাড়া হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। তাদের ক্ষেত্রে মানবিক দিকটাই বেশি বিবেচনা করে পুলিশ।

কোন মহানগরে কতজন পুলিশের সহায়তা নেন

১ জানুয়ারি থেকে ১৫ মে পর্যন্ত দেশের ৫ মহানগরীর মধ্যে পাঁচটিতে হিজড়ারা উৎপাত শুরু করার পর পুলিশের সহায়তা চান ভুক্তভোগীরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এলাকায় ৪২১ জন আক্রান্ত হন। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরে সবচেয়ে বেশি ৩৯ জন, সবচেয়ে কম (একজন) তেজগাঁও অঞ্চলে, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) এলাকায় ৩৫ জন, খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) এলাকায় ৫ জন, রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) এলাকায় ২২ জন, বরিশাল মহানগর পুলিশের (বিএমপি) এলাকায় ৮ জন আইনি সহায়তা চান।

জেলায় পুলিশের সহায়তা নেওয়ার চিত্র

দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩০টিতে হিজড়ারা বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাঁদার জন্য মানুষের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তাদের সরিয়ে নিতে পুলিশকে ডাকা হয়। বাগেরহাটে ২, ভোলায় ১, বগুড়ায় ১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২, চট্টগ্রামে ৬, কুমিল্লায় ৮, ঢাকায় ১১, দিনাজপুরে ২, ফরিদপুরে ১, গাইবান্ধায় ১, গাজীপুরে ১৫, গোপালগঞ্জে ১, হবিগঞ্জে ৪, জয়পুরহাটে ১, কিশোরগঞ্জ ২, লক্ষ্মীপুরে ১, মাদারীপুরে ১, মৌলভীবাজারে ১, ময়মনসিংহে ৩, নড়াইলে ৩, নারায়ণগঞ্জে ১৬, নরসিংদীতে ৬, নাটোরে ১, নোয়াখালীতে ১, পিরোজপুরে ১, রাজবাড়ীতে ২, সাতক্ষীরায় ১, সিরাজগঞ্জে ৩, সিলেটে ১ ও টাঙ্গাইলে ১ জন পুলিশের সহায়তা চান।

ভুক্তভোগীদের বক্তব্য

রাজধানীতে মোহাম্মদপুরের বাঁশবাড়ি এলাকায় ভাড়া থাকেন হাবীবুর রহমান। গত এপ্রিলে তিনি বাবা হন। এ খবরে ১৬ এপ্রিল হিজড়ারা তার বাসায় গিয়ে পাঁচ হাজার টাকা বকশিশ চান। তখন বাসায় কোনও পুরুষ সদস্য ছিলেন না। নারীরা তাদের এক হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে চাইলেও তারা হট্টগোল করেন। এ অবস্থায় পাশের বাসার এক তরুণ ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন করেন। মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে।

গত ৭ মার্চ চট্টগ্রামের আকবরশাহ থানা এলাকার রিলায়েন্স টেক্সটাইল লি. নামে একটি পোশাক কারখানায় চার হিজড়া গিয়ে সেখানকার জিএম শাহজাহানের কাছে দশ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা হট্টগোল শুরু করেন। একপর্যায়ে তারা জিএম শাহজাহানের পকেট থেকে তিন হাজার টাকা তুলে নেন। পোশাক কারখানার কর্মচারীরা আকবরশাহ থানায় ফোন দেওয়ায় পুলিশ গিয়ে চার হিজড়া কোহিনূর, ঊর্মি, শ্যমালী ও নদীকে আটক করে। এ ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা করা হয়েছে। আকবরশাহ থানার এসআই আবু আহম্মেদ চৌধুরী এর তদন্ত করছেন।

হিজড়া সংগঠনের নেতাদের বক্তব্য

হিজড়া কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবিদা সুলতানা মিতু জানান, এই চাঁদাবাজির বিষয়ে তারা ২০১৭ সালে পুলিশ সদর দফতরে একটি লিখিত দিয়েছেন। সেখানে তারা দাবি করেছেন, কিছু যুবক হিজড়া সেজে গাড়িতে, সড়কে, দোকানে চাঁদাবাজি করছে। তাদের জন্য প্রকৃত হিজড়াদের মানুষ ঘৃণা করছে। দুর্নাম হচ্ছে। এই চাঁদাবাজদের ধরতে পুলিশের সহায়তা চাওয়া হয়েছিল ওই লিখিত আবেদনে। চাঁদাবাজির সঙ্গে প্রকৃত হিজড়ারা জড়িত নন বলে মিতু দাবি করেন।

হিজড়াদের অধিকার আদায় নিয়ে কাজ করে ‘সাদা-কালো’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর সভাপতি হিজড়া অনন্যা বণিক। তিনি ৪টি বিউটি পার্লারের মালিক। অনন্যা বলেন, ‘আমাদের কাছেও খবর রয়েছে রাস্তাঘাটে, বাসাবাড়ি, দোকান ও গাড়িতে মানুষকে বিরক্ত করা হচ্ছে। এটা চরম আকার ধারণ করেছে। মানুষ বিরক্ত হচ্ছেন। সময় এসেছে হিজড়াদের এই দুর্নাম এখনই বন্ধ করার।’

তিনি বলেন, “যেসব থানা এলাকায় হিজড়ারা ‘তোলা’ উঠিয়ে জীবনযাপন করেন, তাদের নিয়ে থানা পুলিশের বসা উচিত। তাদের বোঝানো উচিত। পাশাপাশি তাদের কর্মসংস্থানের বিষয় সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিতে হবে বলে মত দেন তিনি। বলেন, হিজড়াদের নিজেদেরও কাজের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে।” তিনি বলেন, ‘আমি মানুষের সহযোগিতা নিয়ে একটি পার্লার দিয়ে শুরু করেছিলাম। এখন আমার চারটি পার্লার হয়েছে।’

পুলিশ যা বলছে

পুলিশ সদর দফতরের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেন, ‘দেশের সব নাগরিকের জন্য আইন সমান। হিজড়াদের বিষয়েও তাই। তবে তারা সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। তাদের বিষয় মানবিক দিকটি বিবেচনা করা হয়। তারা ফৌজদারি কোনও অপরাধ করলেই কেবল তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর