প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর যেন ইউপি চেয়ারম্যানের পৈত্রিক সম্পত্তি!

কক্সবাজারের পেকুয়ায় উজানটিয়া ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর বিতরণে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগের শেষ নেই। ইউনিয়নের বিধবা, হতদরিদ্র, ভূমিহীনদের বাদ দিয়ে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে স্বজনপ্রীতি করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, ব্যক্তিগত সহকারী, প্রবাসীদের দিয়েছেন ঘর বরাদ্দ।

এছাড়াও নিজস্ব লোকজনের সুবিধার্থে অবৈধভাবে অন্যের জমি দখল করে প্রভাব খাটিয়ে রাস্তা নির্মাণসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রতিকার চেয়ে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের বরাবর একাধিক লিখিত অভিযোগে প্রেক্ষিতে ঘর আত্মসাৎ এর ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কৌশলে পার পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। চেয়ারম্যানের এমন কাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে বলে মন্তব্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের।

অনুসন্ধানে জানা যায়, উজানটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান শহীদুলের বাবা নুরীর পাড়া এলাকার বাসিন্দা মৃত মফিজুল ইসলামের বাড়িতে মজুরের কাজ করতেন গোলাম সোবাহান নামের এক ব্যক্তি। সেই সুত্রে মফিজুল ইসলাম জীবদ্দশায় গোলাম সোবাহানকে উজানটিয়া মৌজার ২১৯ নং খতিয়ানের ৩৪৫৭ দাগে ৮ শতাংশ জমি লিখিতভাবে দান করেন। গোলাম সুবাহানের মৃত্যুর পর উক্ত জমিতে তার বিধবা স্ত্রী বুতিজা বেগম বসবাস করতেন। ২০১৯ সালে চেয়ারম্যানের সহযোগীতায় ৩৪৫৭ দাগের উপর বিধবা বুতিজা বেগমের নামে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের একটি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু চেয়ারম্যান আত্মসাৎ এর উদ্দেশ্যে নিজের মালিকানাধীন একই খতিয়ানের ৩৪১৮ নং দাগে উক্ত ঘরটি নির্মাণ করেন। ঘরটির মালিকানা থেকে বুতিজা বেগমকে অধিকার বঞ্চিত করে বর্তমান চেয়ারম্যানের বড় ভাই সেলিম উদ্দিন ওই ঘরে বসবাস করছেন। ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়য়ার শোকে গত বছর বুতিজা বেগমের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।

 

বুতিজা বেগমের জন্য বরাদ্ধকৃত সরকারি ঘরের কাগজ। ছবি- বার্তা বাজার

অপরদিকে, একই বছর ৬ নং ওয়ার্ডের গোদার পাড়া এলাকার জয়নাল আবেদীনের স্ত্রী মাহফুজা বেগমকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেয়ার বিনিময়ে জোর করে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মাহফুজা বেগম।

এছাড়াও, ৪ নং ওয়ার্ডের মৃত রমজান আলীর ছেলে চিংড়ি ও লবণ ব্যবসায়ী বকুল আহমদ, লেদু মিয়ার ছেলে চিংড়ি ও লবণ ব্যবসায়ী আমান উল্লাহ, বাহাদুর আলমের ছেলে চিংড়ি, লবন ও ট্রলার ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান, ৭ নং ওয়ার্ডে সিরাজুল ইসলামের ছেলে চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী ও অন্তত ১৫ কানি জমির মালিক জাহাঙ্গীর আলম, ৮ নং ওয়ার্ডের রূপালী বাজারের বাসিন্দা আলী আহমদের পুত্র প্রবাসী আমীর উদ্দীনের থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে ঘর বরাদ্দ দেয়ার জনশ্রুতি রয়েছে।

সুত্র জানায়, বুতিজা বেগমের ঘর আত্মসাৎ এর ঘটনায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কক্সবাজার জেলার উপ-পরিচালক শ্রাবন্তি রায়, পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে নিয়ে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি গেলো ৭ সেপ্টেম্বর সরেজমিন পরিদর্শন করেন।

এই বিষয়ে উপ-পরিচালক শ্রাবন্তি রায়ের কাছে জানতে চাওয়া হলে রিপোর্ট জমা দেয়ার আগে কোনো মন্তব্য করা যাবেনা বলে বিষটি এড়িয়ে যান। তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অধিকতর তদন্তের জন্য ফের তাদের ডাকা হবে বলে জানান।

আগামী ইউপি নির্বাচনকে সামনে রেখে তদন্ত রিপোর্ট নির্বাচনের আগে না দেয়ার জন্য অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন বলে মন্তব্য করেছেন চেয়ারম্যানের বড় ভাই মিছবাহ উদ্দীন।

তিনি আরো বলেন, তার অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলার করনে গোন্ডা বাহিনীর হাতে কয়েক দফা হামলার শিকার হয়েছি। সর্বশেষ সমস্ত সম্পত্তি দখলে নিয়ে আমাকে পরিবারসহ এলাকা ছাড়া করেছে। মৃত্যু ভয়ে এখন নিজ এলাকায় ফিরতে পারিনা।

উজানটিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তোফাজ্জল করিম ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, বিভিন্ন সময়ে চেয়ারম্যানের অপকর্মের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা তার চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে। তিনি নিজস্ব বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের দিয়ে গোটা ইউনিয়নকে অনিয়ম আর দুর্নীতির নরকে পরিণত করেছেন। চেয়ারম্যানের এমন কাণ্ড উন্নয়নের সুফল বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ এবং দুর্নাম হচ্ছে সরকারের।

 

মাহফুজা বেগমের জন্য বরাদ্ধ সরকারি ঘরের কাগজ। ছবি- বার্তা বাজার

এছাড়াও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বেড়িবাধ সংলগ্ন পানি উন্নয়ন বোর্ডের জমি দখল করে চিংড়ি ঘের নির্মাণ, স্বজনপ্রীতি ও নিজ অনুসারীদের সুবিধার্থে ইউনিয়ন পরিষদের নাম ব্যবহার করে অন্যের জমির উপর অবৈধভাবে সড়ক নির্মাণ করার অভিযোগে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার বরাবর ২০১৯ সাল থেকে এই পর্যন্ত বেশ কয়েকটি লিখিত অভিযোগের কপি বার্তা বাজার’র হাতে এসেছে। বিগত সময়ে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আঞ্চলিক শীর্ষ গণমাধ্যম বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশের পরেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ হয়নি। তাই চেয়ারম্যানের খুটির জোর নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ইউনিয়নবাসী।

এসব অভিযোগের বিষয়ে চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে তার বিরুদ্ধে উল্লেখিত সকল অভিযোগ আগামী ইউপি নির্বাচন কেন্দ্রীক ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে তিনি বার্তা বাজার’কে জানান, বুতিজা বেগমের স্বামীকে তার পিতা জমি দেয়ার পরে ৩৪১৮ দাগ থেকে আরো দুই শতক জমি দান করেন চেয়ারম্যান। পরে সেই জমির উপরেই প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর করে দিয়েছেন। পরে বুতিজা বেগমের ছেলেরা সেলিম উদ্দীনকে ওই ঘরটি ভাড়া দিয়েছেন। কারো কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছে এমন কোন প্রমাণ নেই এবং ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের ঘর দেয়ার বিষয়টি মিথ্যা। এছাড়া তার সহোদর মিছবাহ উদ্দীনের সাথে তার দলীয় আদর্শগত বিরোধের কারণে তিনি বিভিন্ন দপ্তরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন বলেও দাবী করেন।

চেয়ারম্যানের অপকর্মের বিরুদ্ধে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা না হলে তার সকল অপকর্ম অন্ধকারেই রয়ে যাবে। তাই একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করার দাবী ইউনিয়নবাসীর।

বার্তা বাজার/এসজে

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর