পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে বরফ দেওয়া ইলিশে সয়লাব হয়ে গেছে রাজধানীর বাজারগুলো। তিন-চারবছর আগেও বৈশাখ এলে যে নাগরিক উন্মাদনা লক্ষ্য করা যেত,এখন আর তা দেখা যায় না।
এ কারণে বৈশাখকে উছিলা করে বাজারে প্রচুর ইলিশ এলেও অতীতের যেকোনও সময়ের তুলনায় কম দামেই তা বিক্রি হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজধানীর সুপারশপগুলোর কথা অবশ্য আলাদা। সুপারসপে বিত্তবান ক্রেতাদের জন্য বড় সাইজের ইলিশ বেশি দামেই বিক্রি হচ্ছে। তবে সব ইলিশই বরফজাত, যা জেলেরা ধরার পর এতদিন মজুত করে রাখা হয়েছিল।
নিম্ন আয়ের মানুষেরা ছোট ইলিশের ক্রেতা
রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে,সাধারণ ক্রেতাদের সাধ্যের মধ্যেই বিক্রি হচ্ছে ছোট সাইজের ইলিশ। বরফ দেওয়া এই ইলিশ (কেজিতে ৪-৫টি) বাজারভেদে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বরফের ভেতরে থাকায় এই ইলিশের লেজ ভাঙা এবং চোখ লাল হয়ে দেবে গেছে। সাধারণত নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষেরাই এই ছোট সাইজের ইলিশের ক্রেতা।
ডেমরা এলাকার কোনাপাড়া বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আফজাল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান,আগের মতো এখন আর বৈশাখকে কেন্দ্র করে ইলিশ নিয়ে তেমন বাড়াবাড়ি নেই। আমরাও আর এসময় বিক্রির জন্য ইলিশ আনি না। কারণ, এখন জাটকা সংরক্ষণে ইলিশ ধরার ওপরে নিষেধাজ্ঞা আছে। সে কারণে বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ঝামেলা এড়াতে ইলিশ বিক্রি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। তারপরেও মাঝেমধ্যে মজুত করা বরফজাত ইলিশ বিক্রি করি। সাধারণত নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষেরাই এসব মাছের ক্রেতা।
এই বাজারে কথা হয় ক্রেতা মমিনুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বৈশাখ এলেই ইলিশের কথা মনে পড়ে। বৈশাখের প্রথম দিন ছেলেমেয়েরা ইলিশ খেতে চায়।ওরাতো আর নিষেধাজ্ঞা বেঝে না, মানতেও চায় না। সেজন্য ইলিশ কিনতে এসেছি।’ তিনি বলেন, ‘বড় সাইজের তাজা মাছ তো আর খেতে পারবো না। তাই বরফ দেওয়া ছোট ইলিশ কিনে নিয়ে সন্তানদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
ইলিশের আড়ত এখন তরমুজের গুদাম
আগে পহেলা বৈশাখ এলে দেশজুড়ে ইলিশ যে মাতামাতি হতো— তা মূলত কখনও ইলিশের সাইজ, কখনও দাম নিয়ে। গণমাধ্যমও এসব খবরকে এমনভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতো যে, ইলিশ নিয়ে সৃষ্টি হতো একধরনের প্যানিক। ফলে বৈশাখের আগে বাজারগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়তো ক্রেতারা। তবে এবছর দেশের কোথাও ইলিশ নিয়ে তেমন মাতামাতির সংবাদ পাওয়া যায় নি। বরং ইলিশের বেশিরভাগ আড়ত এখন তরমুজের গুদাম হিসেবে ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ইলিশের সঙ্গে জড়িত জেলেরা এখন অন্য কাজ করছেন।
প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে বেড়েছে সচেতনতা
জাটকা সংরক্ষণে বর্তমানে ইলিশ ধরার ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি আছে, চলবে ৩০ জুন পর্যন্ত। অন্যদিকে পহেলা বৈশাখে ইলিশ বয়কটের প্রচারণাও চলছে। ‘বৈশাখের সঙ্গে ইলিশের কোনও সম্পর্ক নেই’ গত দুই-তিন বছর ধরে বিভিন্ন মহল থেকে জোরেসোরেই একথা বলা হচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পহেলা বৈশাখে ইলিশের বদলে বেগুন ভাজা, শুটকি ভর্তাসহ গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবারের কথা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরায় অনেকের সচেতনতা বেড়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন— তিনি পান্তাভাত আর শুটকি ভর্তা খাবেন। দেশবাসীকেও বৈশাখে এ ধরনের খাবার খেতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এই পরামর্শের প্রতি সম্মান জানিয়ে অনেকেই এখন আর বৈশাখ উপলক্ষে ইলিশ কিনছেন না। আগে অনেক প্রতিষ্ঠানই পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ইলিশের আয়োজন করলেও বছরদুয়েক ধরে তারা এ ধরনের অনুষ্ঠানে ইলিশ বর্জন করেছে। এসব কারণে দেখা— বৈশাখ উপলক্ষে এখন আর বাজারে ইলিশের তীব্র চাহিদা নেই। জেলে, মাছ ব্যবসায়ী, বাজার বিশ্লেষক ও বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এতথ্য জনা গেছে।
রাজধানীর একাধিক বাজারে গিয়ে সরেজমিনে দেখা গেছে, হঠাৎ করেই কমেছে ইলিশের চাহিদা। কাওরান বাজার, নিউমার্কেট, মোহম্মদপুরের কৃষি মার্কেট ও টাউন হল মার্কেটসহ বিভিন্ন সুপার শপগুলোতে ইলিশের চাহিদা ব্যাপকহারে কমেছে। একইসঙ্গে কমেছে দামও।
মিয়ানমারের বরফ দেওয়া সামুদ্রিক ইলিশ
এদিকে, ব্যবসার লোভে কেউ কেউ আগে থেকে ইলিশ মজুত করলেও বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেছে যে, এগুলো দেশীয় নয়— মিয়ানমারের সামুদ্রিক ইলিশ। বরফ দেওয়া এই ইলিশকে এতদিন পদ্মার ইলিশ বা দেশের বিভিন্ন নদীর ইলিশ বলে বিক্রি করা হতো। কিন্তু গণমাধ্যমে এ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর ক্রেতারাও সতর্ক হয়েছেন। ফলে থেকে বিক্রেতারা প্রত্যাশা অনুযায়ী ক্রেতা পাচ্ছেন না। যেসব মজুতদার এবারের বৈশাখে ইলিশের রমরমা ব্যবসার আশা করেছিলেন, তারা এখন লোকসানের আশঙ্কা করছেন।
তাজা ইলিশের দাম সব সময়েই বেশি
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী আড়তের মাছ ব্যবসায়ী কাওসার আহমেদ জানান, পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছের চাহিদা কিছুটা বাড়ে। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে এ সময় ইলিশ ধরা বন্ধ থাকে। তবে সরকারের আদেশ অমান্য করে কেউ কেউ লুকিয়ে ইলিশ ধরে এবং সেগুলো বাজারে এলে বেশি দামে বিক্রি হয়। কারণ, তাজা ইলিশের দাম সব সময়েই বেশি। তিনি বলেন, ‘বৈশাখ উপলক্ষে অনেকে হিমাগারে ইলিশ মজুত রাখেন। দীর্ঘদিন ধরে তাদেরকে হিমাগারের ভাড়া গুনতে হয়। আগে একারণেও বৈশাখ এলে মাছের দাম বেড়ে যেত। কিন্তু এবছর ইলিশের দাম তূলনামূলক কম।
অভিযান জোরদারের নির্দেশ
এদিকে জাটকা ইলিশ নিধনরোধে মৎস্য অধিদফতরের এক আদেশে বলা হয়েছে, মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত নদীতে জাটকার প্রাচুর্যতা দেখা যায়। জেলেদের জালে এসময় বেশি পরিমাণে জাটকা ধরা পড়ে। তাই জাটকা রক্ষার্থে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদেরকে সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং অভিযান জোরদার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে অভিযানের তথ্য মৎস্য অধিদফতরে পাঠাতে বলা হয়েছে।