বাংলাদেশের অদৃশ্য সংখ্যালঘু

ইমতিয়াজ মোর্শেদ : প্রকৃতি বড়ই বিচিত্র তার সৃষ্ট্রি, বৈচিত্র এবং প্রবাহ নিয়ে। হাজার হাজার প্রজাতি যেমন আছে প্রকৃতিতে তেমনি আছে তাদের ভিন্ন গঠন, রুচিবোধ এবং বৈশিষ্ট। প্রাণিজগতে মানুষ এক অনন্য সৃষ্টি। মানুষকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী বলা হয় তার কর্ম এবং ক্ষমতার কারণে। প্রতিটি মানুষই অনন্য, ভিন্ন এবং চিন্তার অধিকারী। প্রাণিজগতে যৌন সম্পর্কের বৈচিত্রতা রয়েছে। এটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক, কিন্তু অনেকেই তা মানতে চাননা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে। বাংলাদেশে ভিন্ন যৌন রুচিবোধ সম্পন্ন মানুষেরা সবসময় নির্যাতিত এবং অবহেলিত।

LGBT মানুষেরা আমাদের ভাই, বোন, বন্ধু, প্রতিবেশী, আমাদের শিক্ষক এবং আমাদের সহকর্মী । পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সমকামীতা এবং উভকামীতা মানব ইতিহাসে সব সময়ই প্রতিটি সমাজ ও প্রতিটি সংস্কৃতির অংশ হয়ে ছিল এবং আছে। আর ব্যাপক প্রাণীকুলেও এর অস্তিত্ব বিদ্যমান। পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে যে, ১০০ জনের মধ্যে ১ থেকে ১০ জন যৌণভাবে বা রোমান্টিকভাবে সমলিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ন্যূনতমপক্ষে দেখা গেছে, বাংলাদেশে অন্ততঃ ১৫ লক্ষ LGBT রয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যক থাকা সত্ত্বেও (যা প্রায় কাতারের পুরো জনসংখ্যার সমান) LGBT অদৃশ্য সংখ্যালঘু হিসেবে গন্য হয়ে আসছে।

বাংলাদেশের সমাজ, সংগঠন, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্মক্ষেত্রে LGBT দের প্রতি বৈষম্য তাদের স্বাস্থ্যসেবা এবং সুবিচার থেকে বঞ্চিত করে। সুবিধা বঞ্চিত এই মানুষগুলো তারা পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের কাছ থেকে খুব কমই সহায়তা পায় এবং বেশির ভাগ সময় নির্যাতিত হয় । বাংলাদেশ পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারায় বলা হয়েছে যে, সমলিঙ্গের মধ্যে যৌণ মিথস্ক্রিয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড। তারফলে , খুব কম মানুষই তাদের যৌন প্রবনতা বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলে। অধিকন্তু, বেশীর ভাগই বাধ্যতামূলক ধর্মীয় গোঁড়ামী, ভ্রষ্ট ধারণা এবং সুবিচার আর নৈতিকতার পরিহাসের বেড়াজালে পড়ে গোপনীয়তার জীবন যাপনে বাধ্য হয়। এখনও নারীদের জীবনের মোক্ষ হিসেবে বিপরীতগামী (heterosexual) বিবাহ বিবেচিত, আর সমকামী নারীদের প্রতি সহনশীলতা বিশেষভাবে কম। নারীরা দ্বিগুন ভাবে নির্যাতিত এবং নিষ্পেষিত হয় তথাকথিত সমাজের বিধি-নিষেধ দ্বারা ।

২০০২ সনে বাংলাদেশের LGBT গোষ্ঠীর সবচেয়ে বৃহত্তর সংগঠন বন্ধু স্যোসাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (Bandhu Social Welfare Society বা BSWS) ১২৪ টি স্বচিহ্নিত নারী সমকামী এবং উভকামী পুরুষদের উপর জরিপ চালায় যা তর্ক সাপেক্ষে স্থানীয় LGBT গোষ্ঠীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ। প্রতি দুই জনের মধ্যে একজন ব্যাক্তি বলেছে যে, স্কুল বা কলেজে হয়রানির শিকার হওয়ার কথা।এছাড়া , প্রতি চার জনের মধ্যে তিন জন, যারা তাদের আত্মীয় পরিজনকে নিজের যৌন প্রবণতা সম্পর্কে জানিয়েছে। তারা বলেছে যে তারা তাদের পরিবারের কাছ থেকে খুব নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছে; যেমন শারীরিক আক্রমণ, জোরপূর্বক বিয়েতে বাধ্য করা, পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত, বাড়ি ছাড়া করা অথবা তাদের সমকামীতা থেকে আরোগ্যের জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া । অনেকেই আইন প্রয়োগকারী সদস্য, স্থানীয় মস্তান, বন্ধুস্থানীয় কেউ অথবা পরিবারের কোন সদস্য দ্বারাও নিগৃহিত হয়েছে। জরিপে ৮০ জনের মধ্যে ২৯ জন BSWS কে এই মর্মে রিপোর্ট করেছে যে, তারা আইন প্রয়োগকারী সদস্যদের দ্বারা হয়রানীর শিকার হয়েছে অথবা পুলিশ অফিসাররা তাদের ধর্ষন সহ বিভিন্ন যৌন নিপীড়ন চালিয়েছ। অন্যান্যরা তাদের উপর মারধর, বলপ্রয়োগে অর্থ আদায়, গতিবিধি বাধাগ্রস্ত করা, হুমকি এবং ব্ল্যাকমেইল করার কথা জানিয়েছে। ময়মনসিংহ, ঢাকা এবং সিলেটের সমকামীরা রিপোর্ট করেছে যে, তাদের পুলিশ ব্যারাক বা পুলিশ চৌকিতে ধরে নিয়ে গিয়ে দলগত ধর্ষণ করা হয়েছে। ২০০৩ সালে হিউম্যান রাইট ওয়াচ (HRW) –এর রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এ ধরনের ঘটনাগুলো মাঝে মধ্যেই ঘটে এবং এ থেকে বাংলাদেশে LGBT গোষ্ঠীর উপর সহিংসতার ধরনই প্রকাশ পায়।

বাংলাদেশে LGBT গোষ্ঠীর প্রতি স্থানিক তীব্র আতঙ্ক ও ঘৃণার কারণে LGBT দের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুখ-সমৃদ্ধির উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রমুখের দ্বারা পরিচালিত ১০২ জন পুরুষের উপর এক সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে যে, এদের মধ্যে শতকরা ৩২ জনের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতার নজির রয়েছে এবং শতকরা ৪৭ জন অন্ততঃ একবার হলেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

ভুলবশতঃ মাঝে মাঝে ভাবা হয় যে, যৌন প্রবণতা “একটি পছন্দ” অথবা “একটি অসুখ”- যার কোনটাই সঠিক নয়। এটা মনুষ্য যৌনতার একটি স্বাভাবিক দিক। LGBT গোষ্ঠীর সম্পর্ক নারী-পুরুষের সম্পর্কের মতই প্রাকৃতিক এবং মানবিক বন্ধনের একটি স্বাস্থ্যকর ধরন।LGBT রা বিশেষ অধিকার দাবী করে না বরং তারা তাদের মানবিক অধিকারের স্বীকৃতি চায়। সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা সমকামীতাকে আনুকূল্য দেখায় না এবং বর্ণবৈষম্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। LGBT দের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ এবং হয়রানী করা, তাদের সমান সুযোগ এবং সম্মান দিতে অস্বীকার করা অথবা তাদের অভিযুক্ত করা ইত্যাদি আচারনিষ্ঠ বা সভ্য- কোনটাই নয়, বরং এগুলো অনৈতিক। একজন ব্যক্তির যৌন ঝোঁক বা প্রবণতা সেই ব্যক্তির একটি অংশ এবং প্রত্যেকেরই তারা যা, সে জন্যই সম্মানের প্রাপ্য।

বাংলাদেশ আইন, বিচার ও সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ৩৭৭ অনুচ্ছেদ “জীবনের অধিকার এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিস্তৃত সংজ্ঞানুযায়ী সাংবিধানিক ভাবে রক্ষিত গোপনীয়তার (privacy) অধিকারকে লঙঘন করে”। সুপ্রিম কোর্টের আইনবিদ সারা হোসেইন অনুচ্ছেদ ৩৭৭ কে আরও দেখেন বৈষম্য-বিরোধী ধারা এবং বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বারা নিশ্চিতকৃত সম অধিকার আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে।সমমনা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যৌনক্রিয়া একটি সহজাত ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং সহিষ্ণুতা ও সম্মানের মূল্য দেয়- এমন সমাজের সরকার দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিৎ নয়। তবুও আইনবিধিমালার ৩৭৭ ধারা ঠিক তাই করছে। ৩৭৭ অনুচ্ছেদ মর্যাদা এবং সমতার মৌলিক নীতিগুলোর সাথে স্ববিরোধী এবং তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙঘন করে। এটা সামাজিক হীনম্মন্যতাকে বেগবান, অন্যান্য বৈষম্যকে উৎসাহিত, গনস্বাস্থ্য উদ্যোগকে অবমনিত করে- যার ভিত্তি কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়।

যদিও ৩৭৭ অনুচ্ছেদ প্রায় ব্যবহৃত হয়ই না, কিন্তু এটা LGBT গোষ্ঠীর জন্য ডেমোক্লেস (Damocles) এর তরবারীর মতো এবং গোঁড়া ও অসহিষ্ণুদের দ্বারা এটাকে অজনপ্রিয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়ার আগেই সাবধান হতে হবে। একটি স্বাধীন এবং গনতান্ত্রিক জাতি হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অনুচ্ছেদ ৩৭৭ রদ করা একটি অখন্ড পদক্ষেপ। এটি রদ বা বাতিল করলে LGB, যারা ধর্ষনের শিকার- তাদের জন্য, দোষীদের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকি ছাড়াই নালিশ করা এবং পুলিশের সেই অস্ত্র কেড়ে নেয়া সম্ভব হবে যার দ্বারা তারা নাকাল, নির্যাতিত এবং ব্ল্যাকমেইল হচ্ছে। যদিও সাখাওয়াত অভিযুক্ত হতে ভয় পায় না, তথাপি সে রাষ্ট্রের চোখে একজন অপরাধী। LGB অধিকারের সমর্থনকারী হিসেবে সে বিশ্বাস করে যে, অনুচ্ছেদ ৩৭৭ বাতিল করলে “তা LGBT গোষ্ঠীকে প্রকাশিত হওয়া সহজতর করার মাধ্যমে আরও ভাল দৃষ্টিগ্রাহ্যতা এনে দেবে”।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর