জাতীয় নেতার ধারণা কি বিলুপ্তির পথে!

‘জাতীয়’ নেতা বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তিনটি ছবি ‘হক-ভাসানি-সোহরাওয়ার্দী’। অর্থাৎ শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মূলত: ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকালে যুক্তফ্রন্ট গঠনই এই তিন নেতাকে এক ফ্রেমে নিয়ে এসেছে। আবার ‘চার জাতীয় নেতা’ শব্দটি বলা যায় অনেকটা অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে জেলহত্যার শিকার সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানের ক্ষেত্রে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতির পিতা হিসেবে অধিষ্ঠিত। গত চার দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির শীর্ষ নেতা হচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া।

জাতীয় নেতা বলতে আমরা বুঝি যার রাজনৈতিক প্রভাব সারাদেশেই থাকে। তিনি কোথাও গেলে মানুষ তাকে দেখার জন্য কিংবা তাদের কথা শোনার ব্যাপারে আগ্রহী হন এমন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের। খুব বেশি দূরে যাওয়ার দরকার নেই, আমরাই দেখেছি এমন নেতাদের মধ্যে আবদুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, আবদুল মান্নান ভূইয়া, মিজানুর রহমান চৌধুরী, কাজী জাফর আহমেদ, মওদুদ আহমদ, খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন, আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মোহাম্মদ নাসিম, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কেএম ওবায়দুর রহমান, আব্বাস আলি খান, মতিউর রহমান নিজামী, প্রমুখ নেতাদের সারাদেশের মানুষ এক নামে চিনতো।

তাদের নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, সমালোচনা ছিল, কিন্তু দেশের প্রতিটি স্তরের মানুষই তাদের নাম জানতো, তাদের চিনতো। এই পর্যায়ের জাতীয় নেতাদের মধ্যে এখন রাজনীতিতে আছেন আমির হোসেন আমু , তোফায়েল আহমেদ ও মতিয়া চৌধুরী কিন্তু তারা খুব একটা সক্রিয় নন। বি চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনও তাই। শেখ সেলিম, কাজী জাফরুল্লাহ- তারা দল কোন দায়িত্ব দিলে তা পালন করেন, না দিলে নাই। রাশেদ খান মেনন আর হাসানুল হক ইনুও অনেকটা ইস্যুভিত্তিক রাজনীতি করেন। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সক্রিয় নন, মনজুরুল আহসান খান বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। কর্ণেল (অব.) অলি আহমেদ বিএনপি ছাড়ার পর রাজনীতিতে আর শক্ত মাটি পাননি।

বর্তমান সময়ে রাজনীতি করা নেতাদের মধ্য থেকে মন্ত্রী হচ্ছেন, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হচ্ছেন, স্থায়ী কমিটির সদস্য হচ্ছেন কিন্তু তাদের রাজনৈতিক প্রভাব কতটুকু? মন্ত্রীর জায়গা থেকে যদি বিচার করি তাহলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হিসেবে একজন জিল্লুর রহমান, মান্নান ভূইয়া যে পর্যায়ের প্রভাবশালী ছিলেন এখনকার স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর কি সেই প্রভাব আছে? একজন অর্থমন্ত্রী হিসেবে এম সাইফুর রহমান কিংবা আবুল মাল আদুল মুহিত যে প্রভাবশালী ছিলেন এখনকার অর্থমন্ত্রীর কি সেই প্রভাব আছে?

আবার দলীয় জায়গা থেকে দেখলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে এক সময় যারা ছিলেন তাদেরকে সারাদেশের মানুষই চিনতো, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের ক্ষেত্রেও তাই। এখনও এই পদগুলোতে কেউ না কেউ আছেন কিন্তু সাধারণ মানুষ বা দলগুলোর নেতারা তাদের কতটা চেনেন বা জানেন।

এক সময় এই ঢাকা নগরীতেও মোহাম্মদ হানিফ আর সাদেক হোসেন খোকার মত নেতা ছিলেন, ঢাকার প্রতিটি অলিগলিতে তাদেরকে মানুষ চিনতো, এখন সারা ঢাকায় প্রভাব বিস্তার করবেন এমন কোন নেতা কি আছে বিএনপি বা আওয়ামী লীগে? উত্তর-দক্ষিণে ভাগ হওয়ার পর ঢাকার নেতারা এখন আর ঢাকারও নেতা, ঢাকা উত্তরের নয়তো দক্ষিণের নেতা। জননেতারা এখন অনেকটা কর্মীদের নেতায় পরিণত হয়েছেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ‘পুরান’ নেতাদের মধ্যে এখন রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, শেখ সেলিম। কাজী জাফরুল্লাহ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন (চট্টগ্রাম), আবুল হাসনাত আবদুল্লাহও প্রবীণ নেতা। রাজনীতির মেয়াদ বিচারে ৪০ বছর বা তারও বেশি রাজনীতি করা নেতারাও প্রবীণ বা জ্যেষ্ঠ নেতা হন না, সে বিচারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অনেক সদস্য এখনও ‘জ্যেষ্ঠ’ নন। আওয়ামী লীগের সু সময় কিংবা দু:সময়ে ঘুরে ফিরে আসে আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ আর মতিয়া চৌধুরীর নাম। কিন্তু গত এক দশকে তারা বলা যায় রাজনীতিতে ‘টিকে’ আছেন। দলের নীতি নির্ধারণী ফোরামে নাই, মন্ত্রিসভায় নাই। এর মধ্যে মতিয়া চৌধুরীকে কিছুদিন আগে সংসদ উপনেতার পদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে হাসানুল হক ইনুর ভাষায় বলা যায় ‘ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছেন’।

পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে নাম আসছে অনেকের, সেখানে তেমন কোন ‘প্রভাবশালী’ রাজনৈতিক নেতার নাম নাই, যাদের নাম আসছে বোঝা যায়, রাজনীতিতে ভূমিকা বা অবদানের জন্য তারা রাষ্ট্রপতি হতে পারেন এমনটা অনেকেই বিশ্বাস করে না, তাদের যে কেউ রাষ্ট্রপতি হয়ে যেতে পারেন ক্ষমতার আনুকূল্য’র কল্যাণে। রষ্ট্রপতি পদটি আলংকরিক হলেও বিএনপি আমলে বদরুদ্দোজা চৌধুরী দলের সর্বজ্যেষ্ঠ নেতা হিসেবেই এ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলন। আওয়ামী লীগও জিল্লুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল জ্যেষ্ঠতা বিবেচনায়, বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জ্যেষ্ঠতম নেতা না হলেও ছিলেন জ্যেষ্ঠ নেতা, মূলত: স্পিকারের আসন থেকে তিনি উঠে গেছেন রাষ্ট্রপতির আসনে।

আগামীর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাজনীতি না রাজনৈতিক আনুকূল্য গুরুত্ব পাবে তা তা ষ্পষ্ট হতে শুরু করেছে, তবে শেষ পর্যন্ত কী হবে তা সময়ই বলে দেবে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে কাউকে নির্বাচনের ক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, রাজনীতিতে অবদানের বিষয়টিকে শুধু বিবেচনায় নিলেই হবে না, গুরুত্বও দিতে হবে। রাজনৈতিক পদগুলোতে রাজনীতিবিদরা অধিষ্ঠিত হবেন সেটাই স্বাভাবিক। কারণ, এটা তাদের সারা জীবনের ত্যাগ আর পরিশ্রমের ফসল। অনেকেই আক্ষেপ করে বলেন, রাজনীতিটা আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই।
রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের হাতে ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনীতিবিদদের তাদের প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা আর পদ দিতে হবে। যদি তা করা হয় তবে তা শুধু রাজনীতিবিদদেরই প্রাপ্তি হবে না, একই সাথে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে পারে, নতুন আশাবাদের জায়গা তৈরি করতে পারে, চলমান রাজনৈতিক অবস্থায় ‘আশা’ তৈরি করাটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

লেখক : বার্তা সম্পাদক বাংলাভিশন ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর