ঘাটাইলে ৪০ দিনের কর্মসৃজনের কাজ না করেই বিল উত্তোলন

টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে কাল্পনিক প্রকল্প ও ভুয়া মাষ্টাররোল তৈরি করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সকল নিয়মনীতিকে উপেক্ষা করে সরকারের অন্যতম বৃহৎ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রকল্প অতিদরিদ্রদের কর্মসৃজনের নামে ৪০ দিন কর্মসূচির বরাদ্ধকৃত অর্থের কমপক্ষে চারকোটি টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে সিন্ডিকেট। আর এ সিন্ডিকেটে রয়েছেন ইউএনও, প্রকল্পবাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এবং দু‘জন জনপ্রতিনিধি।

সুত্র মতে- ২০১৮-১৯ অর্থ বৎসরে ঘাটাইল উপজেলায় ৪০ দিন প্রকল্পের প্রথম পর্বের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান বিভাগ ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর তারিখে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৫১ হাজার ২৩৯ টাকা বরাদ্ধ দেন। দ্বিতীয় পর্বের জন্যও চলতি বছরের ১৯ জুন তারিখে সমপরিমান অর্থ ঘাটাইল সোনালী ব্যাংকে ইউএনও এবং পিআইও‘র যৌথভাবে পরিচালিত মাদার একাউন্টে জমা হয়।

কিন্তু পিআইও গেল বছর ১৭ অক্টোবর মাসিক সমন্বয় সভায় ত্রান বিভাগ কর্তৃক ৪০ দিন প্রকল্পের নামে প্রথম পর্বে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৪ হাজার টাকা বরাদ্ধ পেয়েছেন বলে জানান। আবার চলতি বছর ২০ মার্চ তারিখের একইভাবে ত্রান বিভাগ কর্তৃক দ্বিতীয় পর্বের জন্যও প্রথম পর্বের ন্যায় সমপরিমান টাকা বরাদ্ধ পাওয়া গেছে বলে মাসিক সমন্বয় সভায় উপস্থাপন করেন।

কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ত্রান বিভাগ উল্লেখিত অঙ্কের কোন অর্থ ঘাটাইল উপজেলা হিসাব শাখায় জমা হয়নি। বরাদ্দের আসল অংককে আড়াল করে দুরভিসন্ধিমূলক মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা হয়, ফলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে প্রকল্প শুরুর আগেই ২৬ লাখ ৯৪ হাজার ৪৭৮ টাকা একাউন্ট থেকে লাপাত্তা হওয়ার ঘটনা।

এখন আমরা দেখব, ৪০ দিন প্রকল্পে দু’পর্বে ৮০ দিনের জন্য বরাদ্দকৃত ৪ কোটি ৯৩ লাখ ২ হাজার ৪৭৮ টাকার কাজ। উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ১৩৬টি প্রকল্পে উপকারভোগি নিয়োগ দেয়া হয় ৫ হাজার ৮‘শ ২৬ জন। নিয়ম অনুযায়ী ইউনিয়নওয়ারী সর্বস্তরের জনগনের সাথে আলোচনা করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৪০ দিন কর্মসূচির প্রকল্প তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। ওই তালিকা ইউনিয়ন পরিষদের নোটিশ বোর্ডে লটকিয়ে প্রচার করতে হবে। কোন আপত্তি থাকলে তা নিষ্পত্তি করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।

তারপর প্রকল্পস্থলে প্রয়োজনীয় তথ্যসম্বলিত সাইনবোর্ড স্থাপন পূর্বক প্রকল্পের কাজ আরম্ভ করতে হবে। উপকারভোগিদের মজুরি প্রদানের লক্ষে ইউএনও এবং পিআইও‘র যৌথভাবে পরিচালিত উপজেলা মাদার একাউন্ট থেকে চাইল্ড একাউন্টে অর্থ স্থানান্তর করতে হবে।

উপকারভোগিদের জব কার্ডে বর্নিত কর্মদিবস অনুসারে প্রদেয় মজুরি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ম্যানেজার চাইল্ড একাউন্ট থেকে উপকারভোগির স য়ি হিসাব নম্বরে স্থানান্তর করবে। প্রকল্পের কাজ তদারকির জন্য ইউনিয়নওয়ারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় ট্যাগ অফিসার। তাদের প্রত্যয়নের ভিত্তিতে অগ্রগতি অনুযায়ী উপকারভোগীদের জব কার্ডে বর্নিত কর্মদিবস অনুসারে ব্যাংকে স্ব-শরীরে হাজির হয়ে চেকের মাধ্যমে প্রদেয় মজুরি উত্তোলনের কথা।

অথচ উপকারভোগিদের জব কার্ড ও চেক বই থাকে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বারদের কাছে। তারা চেকের পাতায় উপকারভোগিদের কাছ থেকে অগ্রীম স্বাক্ষর/টিপসহি নিয়ে রাখেন। সপ্তাহে ৫ দিন কাজ করার পর একদিন নির্ধারিত থাকে উপকারভোগিদের মজুরি উত্তোলনের জন্য। অথচ ব্যাংক থেকে বিল উত্তোলন করা হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১ থেকে ৩ মাস পর। প্রশ্ন হচ্ছে-কাজ যদি হয়ে থাকে তাহলে ২/৩ মাস পর টাকা উত্তোলন করা হলো কেন?

সরেজমিনে ১৪টি ইউনিয়ন ঘুরে স্থানিয়দের সাথে আলাপে লুটপাটের ভয়াবহতার চিত্র উঠে আসে। অনেকেই জানেন না এ বৎসর ৪০ দিন প্রকল্পের কোন কাজ আছে কিনা । আবার কেউ কেউ বলেছেন মাঝে মধ্যে ২/৪ জন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে। তবে কোথাও প্রকল্পের কোন সাইনবোর্ড চোখে পড়ে নাই।

স্থানিয়দের ভাষ্যমতে, জামুরিয়া ইউনিয়নে ৪০ দিন কর্মসূচির কোন শ্রমিক একদিনের জন্যও কাজ করে নাই। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জানান, আমি যে কাজ করেছিলাম সেগুলো দেখিয়ে বিল তোলা হয়।

উপজেলার ঘাটাইল ইউনিয়নে কয়েকদিন পরিদর্শনে গিয়ে শুধু দেলোয়ার হোসেন লেবু মেম্বারের কিছু শ্রমিক ছাড়া এ ইউনিয়নে ৪০ দিন কাজের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

এভাবে উপজেলার দিঘলকান্দি, লোকেরপাড়া, দিগড়, দেওপাড়া, ধলাপাড়া, রসুলপুর, সাগরদিঘী, লক্ষিন্দর, সন্ধানপুর প্রভৃতি ইউনিয়নে প্রকল্পের কোন সাইনবোর্ড দেখা যায়নি। কাজেরও কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এভাবে কাল্পনিক প্রকল্প দেখিয়ে বিল উত্তোলন করা হয়েছে ৮০ শতাংশ কাজের।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইউপি সচিব আক্ষেপ করে বলেন, প্রকল্পের ভুয়া মাষ্টার রোল করতে হয় আমাগো আর বিলের প্রায় সম্পুর্ন টাকা যায় পিআইও আর ইউএনও’র পকেটে। আমরা একেবারে জিম্মি হয়ে পড়েছি। কাগজে কলমে ৮০ শতাংশ কাজ দেখিয়ে কমপক্ষে ৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন এ সিন্ডিকেট। এ জন্য এ অনিয়মের সাথে জড়িয়ে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তাও জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে ধলাপাড়া জনতা ব্যাংক শাখা ম্যানেজার মির্জা লোকমান হোসেনের বিরুদ্ধে রয়েছে গুরুতর অভিযোগ। এনামুল হক নামের স্থানিয় একব্যাক্তি জানান, এ শাখার ম্যানেজার লোকমান মিয়া একজন অর্থলোভী, ঘুষখোর। তারকাছে কোন নিয়ম অনিয়ম নাই।
স্থানীয় এক ইউপি মেম্বার জানান, এখানে কর্মসূচির কোন কাজ না হলেও ম্যানেজারের সাথে আতাত করে পুরো বিল উত্তোলন করা হয়েছে।

রসুলপুর ইউনিয়নের শালিয়াবহ গ্রামের বাসিন্দা মোস্তফা জানান- ‘এমদাদের বাড়ি হইতে নিজামের বাড়ি’ নামক ৪০ দিন প্রকল্পে ৫৩ জন শ্রমিকের কাজ করার কথা, সেখানে কাজ করছে ৯-১২ জন শ্রমিক। তাও হয়েছে সর্বোচ্চ ৭/৮ দিন পর্য়ন্ত। একই ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেনও একই কথা বললেন।

জানতে চাইলে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম খান বলেন, আগে প্রকল্প পরিদর্শন করছি, গেছি। তখন কাজ হয়েছে। আমার মেয়াদ শেষ হবার ২ বছর আগে থেকে আমি অসুস্থ্য হয়ে পড়ি। দুই বছরের মধ্য কিছু করি নাই। ওই সময় আমার বাসায় ফাইল নিয়ে গেছে আমি শুধু স্বাক্ষর দিয়ে দিছি।

এক প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমি একবার চেয়ারম্যানদের ডাইকা বলছিলাম, আমি তখন খুব বেশী অসুস্থ্য। ৬০ হাজার করে টাকা লাগল আমার প্রতি মাস। আমি বলছিলাম, আমিতো খুব নি:স্ব হয়ে পড়লাম। তোমরা আমাদের কিছু সহযোগিতা কইরো। তারা স্বীকার করেছিল কিন্তু দেয় নাই। অসুস্থতার মধ্যে পিআইও আমারে ১০টি টাকাও দেয়নি। কইল, শেষ মেশ যাবেন গা, আপনাকে কিছু টাকা দিমু। তাও দেয়নি।

অপর প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম খান বলেন, এমপি কোটার বরাদ্ধ বরাবরই বেশী। এগুলো শুধু লুটপাটই হয়। কারা কিভাবে করে জানা নাই। তবে কাজ তদারকির দায়িত্ব ডিসির।

অভিযোগ রয়েছে পুরো উপজেলায় ৪০ দিন প্রকল্পের ৫ ভাগ কাজও হয়নি- এমন প্রশ্নের জবাবে ঘাটাইল উপজেলা পিআইও এনামুল হক বলেন, তাইলে কি চাকরি থাকে? এক সাংবাদিক ২০ভাগ কাজ হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি তার কথায় সম্মতি দেন। এ ছাড়া আর কোন কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও মুহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, আমিও ঘুরে দেখেছি শ্রমিকের উপস্থিতি কম ছিল। এ জন্য আমি ১০ শতাংশ বরাদ্দ কেটে দিয়েছি।
শ্রমিক মজুরি সপ্তাহের বিল সপ্তাহে দেয়া হয় কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, তাহলে আর কোন কাজ করতে হবে না। শুধু বিল নিয়েই থাকতে হবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, যা কাজ হয়েছিল তা বন্যায় ধুয়ে গেছে। এটা আমার কথা না, চেয়ারম্যান সাহেবদের কথা।
উল্লেখ ঘাটাইলে ২/১টি এলাকা ব্যতীত পাহাড়ি উচু ভূমি। ফলে বন্যায় মাটি সরে যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। ফলে কাজের সত্যতা যাচাই করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকের এনফোর্সমেন্টের তদন্ত দাবি করেছে এলাকাবাসি।

বার্তাবাজার/ডব্লিওএস

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর