মিয়ানমার সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় কী হচ্ছে?

মিয়ানমারে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় রাখাইন রাজ্যে দুই মাস ধরে অব্যাহত সংঘর্ষ চলছে, যার প্রভাব ক্রমে ক্রমে বেড়েই চেলেছে। এখন এর  প্রভাব পড়ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপরও। বিশেষ করে বান্দরবানের ঘুমধুম ও তমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। অন্যদিকে এসব রাজ্যের অনেক মানুষ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।

সংঘর্ষে মিয়ানমার বাহিনীর গোলা-বারুদ আমাদের সীমানায় এসে পড়ছে। আতঙ্কে আছেন ওইসব সীমান্তের গ্রামবাসী। আগস্ট মাসে বাংলাদেশের এলাকায় গোলা পড়ার কারণে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ।

৪ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় যেকোনো ধরনের গোলার ব্যবহার করার আগে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে তথ্য আদান-প্রদানের রীতি রয়েছে। কিন্তু সীমান্তে এসব গোলাগুলির ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশের সঙ্গে কোনোরকম তথ্য আদান-প্রদান করেনি।

আরাকান আর্মির সঙ্গে একসময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বোঝাপড়া থাকলেও এখন তারা মিয়ানমার আর্মির ওপর বিভিন্ন জায়গায় হামলা করছে, সেটার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটা যেমন ঠিক, তেমনি জীবন বাঁচাতে ওপার থেকে এপারে আবার রোহিঙ্গাদের আগমনও ঘটতে পারে।

সেই সাথে সেখানকার বিদ্রোহীরাও সীমান্ত টপকে ভেতরে চলে আসতে পারে। মানতে হবে সেখানে পেট্রলিং করা বেশ কঠিন। এ অবস্থায় আমাদের বিজিবি এবং অন্য সব নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে।

কিন্তু মিয়ানমারে আসলে কী ঘটেছে? এ প্রশ্ন এখন সবার। অথচ সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমারে কড়া সেন্সরশিপ থাকায় সে দেশের কোনো তথ্য পাওয়া বেশ কঠিন। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি, বান্দরবানের স্থানীয় বাসিন্দা এবং মিয়ানমারের সংবাদপত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যাচ্ছে, আগস্ট মাসের শুরু থেকে সে দেশের রাখাইন, তানপট্টি ও হাকা রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর লড়াই চলছে।

একদিকে যেমন রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে, অন্যদিকে গত মে মাস থেকে কায়াহ, কাইন ও চিন রাজ্যেও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

এই যুদ্ধে হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমানও ব্যবহার করছে সে দেশের সামরিক বাহিনী। থাইল্যান্ডভিত্তিক মিয়ানমারের দৈনিক ইরাবতির খবর অনুযায়ী, ৪ সেপ্টেম্বর মংডুতে আরাকান আর্মির (এএ) হামলায় সীমান্ত রক্ষী পুলিশের অন্তত ১৯ জন নিহত হয়। তারা ওই স্টেশনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায়।

এরপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার নিয়ে বিমান হামলা শুরু করে। রাখাইন রাজ্যের একাধিক স্থানে এসব বিমান ও হেলিকপ্টার থেকে গোলাবারুদ এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। গত আগস্ট মাস ধরে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই চলছিল।

একমাস ধরেই প্রতিদিন সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে। কয়েকদিন ধরে যুদ্ধবিমান আর হেলিকপ্টার থেকে গোলা ছুড়তে দেখা গেছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে সাংবাদিকরা তথ্য পেয়েছেন, মিয়ানমারের ভেতরে আরাকান বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে। সেনাবাহিনী একের পর এক গ্রামে অভিযান চালাচ্ছে। অনেক গ্রামে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিসের তথ্য অনুসারে, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের আগে ২০২০ সালে আরাকান আর্মির সঙ্গে সে দেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতি সমঝোতা হয়েছিল।

কিন্তু অভ্যুত্থানের পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রাখাইন রাজ্যেও সেনাবাহিনীবিরোধী মনোভাব বেড়ে ওঠে। এরই সুযোগে আরাকান আর্মি ওই যুদ্ধবিরতি থেকে বের হয়ে আবার নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।

২০২৩ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করতে চায় সামরিক জান্তা। এর আগে তারা রাখাইন ও অন্যান্য রাজ্যে নিজেদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। রাখাইন রাজ্য তাদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ রাজ্যের সাথে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত রয়েছে, বলছে ইনস্টিটিউট অব পিস।

দৈনিক ইরাবতি বলছে, দোসরা আগস্ট থেকে আরাকান আর্মি একাধিক জায়গায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর হামলা শুরু করে। এর পাল্টা জবাব হিসেবে অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হেলিকপ্টার ও বিমান হামলার পাশাপাশি সেখানকার ছয়টি সেনা চৌকি থেকে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ শেল ছোড়া হচ্ছে বলে ইরাবতি জানিয়েছে। অপরদিকে সাগাইং ও ম্যাগওয়া অঞ্চলে জান্তাবিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোসের্স (পিডিএফ) সেনাবাহিনীর সঙ্গে তীব্র লড়াই শুরু করেছে।

চীন স্টেটে অন্তত দুটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী- চীন ডিফেন্স ফোর্স ও চিন ন্যাশনাল আর্মি সে দেশের সেনা ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন চালাচ্ছে বহু দিন ধরেই। ইরাবতির খবরে বলা হয়েছে, কায়াহ রাজ্যে গত মে মাস থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে বিদ্রোহী কারেনি ন্যাশনালিটিজ ডিফেন্স ফোর্স, দ্য কারেনি আর্মিসহ কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। পাশের শান রাজ্যেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। বিদ্রোহীদের দাবি, এ পর্যন্ত তারা দেড় হাজার সৈন্যকে হত্যা করেছে- যদিও এই তথ্য নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

গত বছর থেকে সে দেশের গণতন্ত্রকামীরাও আর্মির বিরুদ্ধে নিয়মিত বিক্ষোভ দেখাচ্ছে, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সেই সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউন ও নির্যাতন। এসব বিদ্রোহ দমনে তীব্র গোলাগুলি, মর্টার ছাড়াও বিমান ও ভারী কামানের গোলা ব্যবহার করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারা সেখানকার একাধিক গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে এবং গ্রামে গ্রামে অভিযান চালাচ্ছে। ফলে এসব এলাকা থেকে বহু মানুষ ভারতের মিজোরামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যটি বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন একটি এলাকা। যেখানে সংঘর্ষ চলছে, সেটিও বাংলাদেশের সীমান্তের ঠিক ওপারে। ফলে সেখানকার সংঘর্ষে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশি বাসিন্দারা। গত ২৮ আগস্ট রোবার দুপুর আড়াইটার দিকে বান্দরবান জেলার নাইক্ষংছড়ির তমব্রু উত্তর পাড়ার কাছে মিয়ানমার থেকে ছোড়া দুটি মর্টারশেল এসে পড়ে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানায়।

তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এরপর দোসরা সেপ্টেম্বরে সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে গোলা ছোড়া হলে বাংলাদেশ সীমান্তের দেড়শ মিটার ভেতরে পড়ে বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

যেখানে এই সহিংসতা চলছে, সেই নাইক্ষৎছড়ির তমব্রু সীমান্ত রেখায় সাড়ে চার হাজার রোহিঙ্গা কয়েক বছর ধরে বসবাস করছে। সহিংসতার কারণে তারা বাংলাদেশের ভেতরে চলে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

সীমান্তের ওপারে সংঘর্ষ হলেও এ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ যে জায়গায় সংঘর্ষ হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে, সেখানে চলাচল বেশ কঠিন। এরকম গোলাগুলি হতে থাকলে, তা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে এমন এলাকায়, যেখানে প্রবেশ বা চলাচল করা কঠিন।

আরাকান আর্মির সঙ্গে একসময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বোঝাপড়া থাকলেও এখন তারা মিয়ানমার আর্মির ওপর বিভিন্ন জায়গায় হামলা করছে, সেটার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

এটা যেমন ঠিক, তেমনি জীবন বাঁচাতে ওপার থেকে এপারে আবার রোহিঙ্গাদের আগমনও ঘটতে পারে। সেই সাথে সেখানকার বিদ্রোহীরাও সীমান্ত টপকে ভেতরে চলে আসতে পারে। মানতে হবে সেখানে পেট্রলিং করা বেশ কঠিন। এ অবস্থায় আমাদের বিজিবি এবং অন্য সব নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে হবে। লেখক: সাংবাদিক

বার্তাবাজার/এম.এম 

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর