আমরা চাই রোহিঙ্গারা ফেরত যাক : শি জিনপিং

রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুই বন্ধু প্রতিম বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার উভয় দেশের স্বার্থ দেখেই সংকট নিরসনে সহায়তা করবে চীন। একই সঙ্গে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরত যাক এই বিষয়ে একমত চীন।

শুক্রবার (৫ জুলাই) বিকালে দিয়াওউয়াতি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এসব কথা জানান চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বৈঠকের সার্বিক বিষয় সম্পর্কে জানান।

বৈঠকে দুই নেতা প্রথমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে সম্মত হয়ে বলেন, এটি অমীমাংসিত রাখা যাবে না। চুক্তি স্বাক্ষরের পর দুই বছর পেরিয়ে গেছে, তবে এ ব্যাপারে কোনো সমাধান নেই বলে বৈঠকে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ এবং চীনের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই এই বিষয় বৈঠকে উল্লেখ করে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, রোহিঙ্গারা অবশ্যই তাদের নিজ দেশে ফিরে যাবে।

এসময় দুই দেশের প্রতিনিধিরা যৌথভাবে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কাজ করবে বলে দুই নেতার মধ্যে কথা হয়। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে দুই দেশের প্রতিনিধিরা মিয়ানমারের ওপর ‘গুড উইল’ কাজে লাগাবে বলেও জানানো হয়।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিচ্ছে, যা দেশের জন্য পরিবেশ ও নিরাপত্তার দিক থেকে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে যেতে পারে সেজন্য বাংলাদেশ চীনের ‘গুড উইল’ কামনা করে।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, তার দেশ এরআগেও রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করেছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।
জিনপিং বলেন, আমরা চাই রোহিঙ্গারা ফেরত যাক। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারে যেসব মন্ত্রী কাজ করেন তারা আবারো বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন। আশা করা যায়, এতে এ সংকট নিরসনের আরেকটি সুযোগ সৃষ্টি হবে।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্টকে এ সংকটের বিষয়টি সুন্দরভাবে অবহিত করেন। ভোজ সভায়ও এ আলোচনা উঠে আসে।

শহীদুল হক বলেন, চীনের প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে কিছু প্রশ্ন ছিল। আর প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকটের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্টকে তাদের ‘গুড উইল’ ব্যাবহারের অনুরোধ জানান।

জিনপিং বলেন, যেহেতু এটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টির সামনে উঠছে সেহেতু এর পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা খুবই কম। তিনি বলেন, ‘আমরা এ সংকট সমাধানে যতটা সম্ভব চেষ্টা করব। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দু’দেশই আমাদের ঘনিষ্ট বন্ধু। আমাদের কাছে দু’দেশই সমান, কেউ কম বা বেশি নয়।’

চীনের প্রেসিডেন্ট আশ্বাস দেন যে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দু’টিই যেহেতু উন্নয়নশীল দেশ, সেহেতু তারা (চীন) দু’দেশের স্বার্থই দেখবেন।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুই নেতার মধ্যে বৈঠকটি খুবই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আলোচনা ছিল খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ও উন্মুক্ত, যা বিভিন্ন সমীকরণ ও রসায়নের বহিঃপ্রকাশ।

বৈঠক চলাকালে দুই নেতার অঙ্গভঙ্গি উৎসাহব্যঞ্জক ছিল উল্লেখ করে তিনি জানান, ‘প্রধানমন্ত্রীকে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা পরস্পরের সত্যিকারের বন্ধু হয়ে থাকব।’ তিনি বলেন, ‘অঙ্গীকারের মধ্যদিয়ে দুই নেতার মধ্যকার সম্পর্ক প্রকাশিত হয়েছে।’

শহীদুল হক বলেন, ‘একই সঙ্গে আমরা দেখতে পাই যে দু’দেশের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে একটি পরিণত আখ্যান এসেছে।’
চীনের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে চীনের বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা দুই প্রতিবেশী দেশ উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছি।’

জিনপিং বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করে বলেন, দু’দেশ পরস্পরের উন্নয়ন থেকে শিক্ষা নিতে পারে।

পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুই নেতা গুরুত্ব আরোপ করে বলেন যে তাদের গন্তব্য হল জনগণের উন্নয়ন। তিনি বলেন, চীনের প্রেসিডেন্ট জাতীয় নীতি ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন বোঝাপড়া রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।

জিনপিং দু’দেশ পরস্পরের চ্যালেঞ্জ ও অগ্রাধিকারসমূহ বুঝতে পারে উল্লেখ করে বলেন, ‘এটি সম্পর্কের পরিপক্কতার বহিঃপ্রকাশ।’

চীনের প্রেসিডেন্ট তার দেশ সবসময় বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টার পাশে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা আশা করি এটি ভবিষ্যতে আরো গভীর ও জোরদার হবে।’

দুই নেতা বলেন, তারা দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।

চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পসমূহের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকালে বেশকিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে দু’দেশের মধ্যে ২৭টি চুক্তি ও এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়। তিনি এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

শেখ হাসিনা এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করণে সময় মতো তহবিল ছাড়ে ঋণ চুক্তির শর্তাবলী সহজ করার জন্য চীনের প্রেসিডেন্টের প্রতি অনুরোধ জানান। জবাবে জিনপিং বলেন, এ ব্যাপারে তিনি যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন।

বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ইস্যু প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের বিপরীতে বিশাল বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা হ্রাসে চীনা কোম্পানিগুলোর উচিত আমাদের দেশে বিনিয়োগ করা। বাংলাদেশে চীনের কোম্পানিগুলোর জন্য দু’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, চীনের উদ্যোক্তারা অন্যান্য অর্থনৈতিক অঞ্চলেও বিনিয়োগ করতে পারেন। বাংলাদেশ সরকার দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করেছে।

জবাবে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, তারা এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন এবং বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা হ্রাসে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাবেন বলে আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগে তারা চীনের বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করছেন।

শহীদুল হক বলেন, প্রেসিডেন্ট জিনপিং মুক্তবাণিজ্য, বহুজাতিক বাণিজ্য, ব্যবসাভিত্তিক নিয়মকানুন এবং ডব্লিউটিও’র কার্যকরীতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ডেল্টা প্ল্যান-২১০০, ক্লাইমেট এডাপশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং তিস্তা রিভার কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টুরেশন প্রজেক্ট বাস্তবায়নে চীনের সহায়তা কামনা করেন।

জবাবে চীনের প্রেসিডেন্ট ক্লাইমেন্ট এডাপশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার এবং তিস্তা রিভার কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রেস্টুরেশন প্রজেক্টে চীনের আর্থিক সহায়তা দেয়ার কথা বিবেচনার আশ্বাস দেন।

শহীদুল হক বলেন, উভয় পক্ষ জাতিসংঘে একসাথে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। বৈঠকে উভয় পক্ষ বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। এ করিডোর চীন, বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের জন্য একটি নতুন বাজার উন্মুক্ত করবে।

এসময় অন্যান্যের মধ্যে চেয়ারপার্সন অব ন্যাশনাল এডভাইজারি কমিটি ফর অটিজম এন্ড নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার্স সায়মা ওয়াজেদ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম উপস্থিত ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্টের দেয়া নৈশভোজে অংশ নেন।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর