ভার্চুয়ালে জুয়ার রাজত্ব

জুয়া! সমাজ বিদ্ধংসী এক ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের নাম। জুয়া সম্পর্কে ধরনা কম বেশি সবারই আছে। আমাদের দেশে তাস, ডাবু ক্যাসিনো ইত্যাদির মাধ্যমে জুয়ার পরিচিতি পেলেও এ খেলায় বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ভার্চুয়াল জগৎ।

জুয়ার আসর হিসেবে জুয়াড়িরা ব্যবহার করছে ক্রীড়াঙ্গনকেও। ফুটবল, ক্রিকেট, বাসকেটবল ইত্যাদি খেলাতেও জুয়াড়িরা বাজী খেলছেন প্রতিনিয়ত। তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে জুয়াড়িরাও নতুন নতুন প্রযুক্তিতে জুয়ার রাজ্যের বিস্তার ঘটাচ্ছেন একের পর এক। পুরনো সব পদ্ধতি ছাপিয়ে ভার্চুয়াল জগতে হানা দিয়েছে জুয়া। অফলাইন ছাপিয়ে এখন অনলাইনে জুয়ার আসর জমে উঠেছে। ইতোমধ্যেই সরকারের তরফ থেকে দুই হাজারেরও বেশি জুয়ার (বেটিং) সাইট বন্ধ করলেও প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ওয়েবসাইট।

ভারত থেকে পরিচালিত জুয়া খেলার জনপ্রিয় ওয়েবসাইট তীরকাউন্টার ডটকমের ডেস্কটপ ভার্সন বিগত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বন্ধ করে দেয় সরকার। তবে, আন্তর্জাতিক ভাবে জনপ্রিয় বেট৩৬৫ ডটকমের বেশকিছু সাইট বন্ধ করে দেওয়ার পর তা নতুন করে আর চালু হয়নি। এর বাইরেও চালু রয়েছে আরও অনেক সাইট। এছাড়া বাংলাদেশ থেকে বন্ধ করে দেয়া বিভিন্ন বেটিং সাইট অনেকেই স্ববাভাবিক ভাবে ব্যবহার করতে না পেরে ভিপিএন ব্যবহার করে খেলছেন জুয়া।

সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র সমর্থণ না করলেও আমরা বিভিন্ন সময় দেখেছি সমাজ ও ব্যক্তিত্ব ধ্বংসকারী এ জুয়া খেলায় অংশ নিয়ে সমালচিত হয়েছেন অনেক ভিআইপিরাও।ভারতীয় ক্রিকেট দলের তারকা ব্যাটসম্যান ও তিন ফরম্যাটের অধিনায়ক বিরাট কোহলির গ্রেফতার চেয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্টে মামলা হয়েছে কিছু দিন আগেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অনলাইনে জুয়া খেলার উৎসাহ দিয়েছেন তিনি। একই অভিযোগ আনা হয়েছে অভিনেত্রী তামান্নার বিরুদ্ধেও।

অপরদিকে জুয়ার ভয়াল ছোবলে আমরা প্রাণ হারাতেও দেখেছি অনেককে। চলতি আগস্ট মাসের ৫ তারিখে শেরপুরের নকলায় জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ইজ্জত আলী (৩৫) নামের এক মৌসুমী ফল বিক্রেতা নিহত হন। তার সাথে দ্বন্দ জুয়ার টাকা নিয়ে। গত সোমবার (১০ আগস্ট) রাত ১২ টার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জুয়ার আসর থেকে পালাতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে খলিলুর রহমান (৩০) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। ২৬ মে মাদারীপুরে জুয়া খেলা নিয়ে সংঘর্ষে রাসেল ঘরামী (২৫) নামে এক যুবক নিহত হয়। গত এপ্রিলের জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে দুপক্ষের সংঘর্ষে এক যুবক নিহত এবং কমপক্ষে আরও ১৫ জন আহত হন।

জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে সারাদেশেই ঘটছে প্রাণঘাতী অনেক ঘটনা। জুয়ার ছোবলে দিন দিন নি:স্ব হচ্ছে হাজারও মানুষ। মানুষের মস্তিস্ককেও মারত্বকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এই খেলাটি। প্রাথমিকভাবে যারা কেবল বিনোদনের জন্য জুয়া খেলা শুরু করেন পরে তাদের অনেকেই এটাতে আসক্ত হয়ে পেশাদার জুয়ারুতে রুপান্তরিত হন। এর ফলে অনেকেই নি:শ্ব হয়ে অপরাধ কর্মে লিপ্ত হচ্ছেন। ভেঙ্গে যাচ্ছে সংসার। অশান্তি বাসা বাঁধছে জুয়াড়ির জীবণে।

ভার্চুয়াল জগতের জুয়া এখন আরও সহজলোভ্য করেছে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার। যেখানে সম্প্রতি যোগ করা হয়েছে লুডু খেলা। গ্রাহকদের বিনোদনের জন্য খেলাটি চালু করা হলেও বর্তমানে জুয়া খেলার জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠেছে এটি।

অন্য সব জুয়া খেলায় পেশাদাররা অংশ নিলেও ম্যাসেঞ্জারের লুডু জুয়ায় অংশ নিচ্ছে স্কুল কলেজের কমলমতী শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ।

গুগল ইউটিউব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে “লুডু খেলে ইনকাম করুন, লুডু ইনকাম, লুডু বিডি, লুডু বেটিং” ইত্যাদি নামের অসংখ্য লুডু গ্রুপের চিত্র। এসব গ্রুপের সদস্যরা প্রথমে ১০/২০/৩০ টাকা দিয়ে বিনোদনের উদ্দেশ্য খেলা শুরু করলেও পরে তাদের আসক্তি ও টাকার পরিমান ক্রমেই বেড়ে যায়। কিশোর বয়সি শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষের কাছে ফেসবুক লুডু জুয়া এখন পরিচিতি পেয়েছে।

এ খেলায় অংশ নেয়াদের মধ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতি গ্রস্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। বিনোদনের জন্য শুরু করা এ খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ে পড়া-লেখা ছেড়ে দিচ্ছে অনেকেই। টাকা শেষ হলে অনেকেই ঝুঁকে পড়ছেন অপরাধ কর্মে। আর এভাবেই ধ্বংসের দিকে চলে যাচ্ছে তাদের সম্ভাবনাময় জীবণ।

সারা দেশে টাকা বা অন্য কিছুর বিনিময়ে তাস, ডাইস, হাউজি খেলাসহ সব ধরনের জুয়া খেলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। রায়ে জুয়া খেলায় অনুমতিদাতা, আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।

আদালত বলেছেন, যেসব খেলার ফল দক্ষতার বদলে ‘চান্স’ বা ভাগ্য দিয়ে নির্ধারিত হয়, সেগুলোই জুয়া খেলা। এছাড়া জুয়া খেলার অপরাধের শাস্তি অপ্রতুল আখ্যা দিয়ে হাইকোর্ট বলেছেন, ১৮৬৭ সালের জুয়া আইনে সাজার পরিমাণ খুবই নগণ্য। মাত্র ২০০ টাকা জরিমানা ও তিন মাসের কারাদণ্ড। এই আইন সংশোধন করে সাজার পরিমাণ বাড়ানো উচিত বলেও মনে করেছেন আদালত।

জুয়ার মতো সমাজ বিধ্বংসী এই কর্মকান্ড বিস্তারে সব নিয়ামক শক্তি গুলোর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে অশান্তি। ধ্বংশ হচ্ছে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। এখন কথা হলো শুধু মাত্র সরকার বা প্রশাসন কি এই জুয়ার ভাইরাস রুখতে পারবে? তা কি আদৌ সম্ভব?? আপনার উত্তর যদি হয় “না! তাহলে এর বিস্তার রোধে করণীয় কি? কি’ বা এর সমাধান! তা আমাদের খুঁজে বেড় করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।

রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা যেমন জরুরী; তেমনি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার সাথি, গণমাধ্যম সহ সামাজিকিকরণের যতোগুলো মাধ্যম আছে সব মাধ্যমকেই জোড়ালো ভূমিকা পালন করতে হবে। কোন ব্যক্তি যেনো জুয়ায় আসক্ত না হয় সে জন্য সমাজের মানুষদেরও সজাগ থাকতে হবে। বিশেষ করে বাবা মায়ের চৌকস বুদ্ধি মত্তা দিয়ে সন্তানকে এ পথ থেকে ফেরানো সম্ভব। অপরদিকে প্রাপ্ত বয়স্কদের নৈতিক শিক্ষায় বলিয়ান হতে হবে। একমাত্র সকলের সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টাই পারে জুয়ার ভয়াল ছোবল থেকে জাতিকে রক্ষা করতে। আমরা উপহার পেতে পারি অপরাধ মুক্ত সুন্দর একটি সমাজ।

খালিদ হাসান
সংবাদকর্মী ও কলাম লেখক

বার্তাবাজার/এমকে

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর