ছাত্রলীগ নেতা সৈকত এখন গণরুমের নেতা

ডাকসু নির্বাচনের সময় ছাত্রলীগ নেতা তানভীর হাসান সৈকত নবীন শিক্ষার্থীদের গণরুম নাম দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি দেয়ার আশ্বাসে ভোট চেয়েছিলেন শিক্ষার্থীদের কাছে। ডাকসুর সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ছয় মাসেও কোন সমাধান দিতে পারেন নি তিনি। তাই ছাত্রলীগ নেতা তানভীর আক্ষেপ থেকে সিট ছেড়ে দিয়ে নাম লিখিয়েছেন গণরুমের খাতায়।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে তানভীর হাসান সৈকত

তানভীর হাসান সৈকত কবি জসীমউদ্দীন হলের আবাসিক ছাত্র। ৩২০ নম্বর কক্ষে থাকতেন তিনি। গত ১ সেপ্টেম্বর রাতে সেখান থেকে তিনি গিয়ে ওঠেন ২০৮ নম্বর কক্ষে। এই হলের অনেকগুলো গণরুমের মধ্যে এটি একটি।

ওই কক্ষের মেঝেতে টানা বিছানা পেতে গাদাগাদি করে থাকেন প্রথম বর্ষের জনা পঁচিশেক শিক্ষার্থী। নাট্যকলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তানভীর হাসান সৈকত এখন রাতে তাদের সাথেই ঘুমান।

গত ৪ সেপ্টেম্বর ওই গণরুমে কেক কেটে সৈকতের জন্মদিন পালন করা হয়। ওই কক্ষের ‘ছোট ভাইদের’ কাছে সৈকত হয়ে উঠেছেন ‘গণরুমের নেতা’।

তানভীর হাসান সৈকতের জন্মদিন পালন করছে গণরুমের শিক্ষার্থীরা

কবি জসীমউদ্দীন হলের ১২০টি কক্ষের ধারণক্ষমতা চারশর কম; কিন্তু শিক্ষার্থী আছে হাজারের বেশি। আবাসন সঙ্কটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব হলের চিত্রই এরকম। ১৭টি হল মিলিয়ে গণরুমের সংখ্যা শতাধিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়া প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের জায়গা হয় এসব গণরুমে। কারা এসব কক্ষে থাকবে তার নিয়ন্ত্রণ থাকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের হাতে।

সৈকত ছাত্রলীগের গত কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন। গত ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকেই সদস্য পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তাকেও প্রথম দিকে ২০৮ নম্বর কক্ষের ওই গণরুমে থাকতে হয়েছিল।

গণরুমের জীবনের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা তারা তুলে ধরেন শিক্ষার্থীরা। সৈকতের চেষ্টায় এসব সমস্যার সমাধান হবে- এমন আশা করার কথাও কেউ কেউ বলেন।

আবার শিক্ষার্থীদের কয়েকজন বলেছেন, সৈকত এসে গণরুমে থাকায় ছাত্রলীগের ‘বড় ভাইদের’ কথা শুনতে হচ্ছে তাদের।

ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র খোরশেদুল আলম বলেন, “অনেক স্বপ্ন নিয়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কিন্তু ভর্তি হয়ে যখন হলের এই গণরুমে থাকতে হয়, তখন মনে হয়, দুঃস্বপ্নের মধ্যে এসে পড়েছি। ছাড়পোকার যন্ত্রণায় ঘুমও হয় না ঠিকমত।’’

তবে ‘বড় ভাই’ সৈকত গণরুমে এসে ওঠায় আশা দেখতে পাচ্ছেন খোরশেদ।

“আমাদের এ সমস্যাটা নিয়ে আগে তেমন কথা হত না। সৈকত ভাই আমাদের সাথে থাকার ফলে এখন অনেকে মাথা ঘামাচ্ছে। আমরা আশা করছি সৈকত ভাইয়ের মাধ্যমেই এর একটা সমাধান হবে।”

সৈকত বলছেন, গণরুম সমস্যার সমাধানে প্রশাসনের ‘দৃশ্যমান’ কোনো পদক্ষেপ না দেখা পর্যন্ত তিনি ওই কক্ষেই থাকবেন।
এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য গত ৫ সেপ্টেম্বর কিছু প্রস্তাবসহ একটি স্মারকলিপি তিনি দিয়ে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে।

ডাকসুর এই সদস্য বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীই মেধাবী। কিন্তু এই গণরুম তাদের মেধার বিকাশের পথে প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায়।”

ডাকসুর সভায় গণরুমের সমস্যা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করার কথা জানিয়ে সৈকত বলেন, “অন্য ছাত্র প্রতিনিধিরাও গণরুমের বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন। তারা আরেকটু বড় করে ভাবুক, এটাই আমি চাচ্ছি, যাতে তাদের ভাবনাটা আরেকটু সামনে আসে, যাদে সবাই মিলে চাপ দেওয়া যায়, প্রশাসন দ্রুত উদ্যোগী হয়।”

এই ছাত্রলীগ নেতা জানান, উপাচার্যের কাছে দেওয়া স্মারকলিপির অনুলিপি তিনি শিক্ষক সমিতির সভাপতি, প্রক্টরের কার্যালয়, সব হলের প্রভোস্টের কাছে দিয়েছেন, ডাকসুর সব নেতাদেরও দিয়েছেন।

“এরপরেও তেমন একটা সাড়া আমি পাইনি। তবে ভিসি স্যার আমাকে বলেছেন যে আমার প্রস্তাবগুলো তিনি প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটিতে পাঠাবেন।’’

জোরালো সাড়া না পাওয়ায় দমে যাননি জানিয়ে সৈকত বলেন, “গণরুমে যেহেতু আমি ঢুকেছি, গণরুমের সমস্যার সমাধান করেই আমি এখান থেকে বের হব। এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমি গণরুমেই থাকব।”

সৈকতের এই পদক্ষেপকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর। অন্যরাতও সৈকতের মত উদ্যোগী হবেন বলে আশা করছেন তিনি।

তিনি বলেন, “হলে থাকতে গেলে শিক্ষার্থীদের যে রাজনৈতিক দাসত্বের শিকার হতে হয়, তা থেকে মুক্তি পাওয়া ছিল ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষার্থীদের অন্যতম মৌলিক চাওয়া। তারা চায়, মেধার ভিত্তিতে হলে সিট পাওয়ার ব্যবস্থাটুকু অন্তত প্রশাসন করবে।

“আমি ভিপি হিসেবে একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও ছাত্রলীগের বাধার মুখে কাজ করতে পারিনি। আমি এ বিষয়ে ভিসি স্যারকে বলে এবং হল প্রভোস্টদের চিঠি দিয়েও কার্যকর কিছু করতে পারিনি। সৈকত ডাকসুর একজন সদস্য হিসেবে নৈতিক জায়গা থেকে গণরুমে যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের খোঁজ খবর নিচ্ছে। তাতে শিক্ষার্থীরাও সোচ্চার হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে ।”

নুর বলেন, সৈকতের মত ডাকসুর অন্যান্য পদধারীদেরও ‘নৈতিক বোধোদয়’ ঘটবে- এই প্রত্যাশাই তিনি করছেন।

সৈকতের অভিনব চেষ্টা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জসীমউদদীন হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. রহমত উল্লাহ বলেন, গণরুমের সমস্যা যতটা না প্রশাসনিক তারচেয়ে বেশি ‘রাজনৈতিক’।

“ডাকসু এবং হল সংসদকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। তারা যদি গণরুমগুলোকে স্বাভাবিক ধারণক্ষমতার মধ্যে রাখতে হল প্রশাসনকে সাহায্য করে, তাহলে হল প্রশাসন কিছু একটা করতে পারবে। আর না হলে হল প্রশাসনের করার কিছু থাকবে না।”

বার্তাবাজার/ডব্লিওএস

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর