‘ইন্টারপোলের হাতে গ্রেপ্তার জেল খাটার’ দাবির পেছনে আরাভ খানের নতুন ‘মিশন’?

দুবাইয়ে ঘটা করে সোনার দোকান খুলে আলোচনায় আসা রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান এক মাস নিষ্ক্রিয় থেকে হঠাৎ সক্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সম্প্রতি লাইভে এসে তিনি ‘ইন্টারপোলের হাতে গ্রেপ্তার’ আর ‘জেল খাটার’ দাবি করেছেন। তার এমন দাবির সত্যতা নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়েছে। যে রহস্য ভাঙতে নানামুখী চেষ্টা গোয়েন্দাদের।

বাংলাদেশ পুলিশের সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) ডেস্ক আরাভের জেলে থাকার বিষয়ে কোনো তথ্য পায়নি বলে জানতে পেরেছে। আরাভের বিষয়ে দুবাই পুলিশকে জানানো ছাড়াও বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কার্যালয়ে যোগাযোগ রাখছে পুলিশ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এর আগে দুবাইয়ে সোনার দোকান উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে রবিউল বা আরাভকে শনাক্ত করার পর তাকে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহায়তা চায় বাংলাদেশ পুলিশ। গত ২৩ মার্চ বাংলাদেশি অপরাধী হিসেবে ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় রবিউল ইসলাম রবিউলের নাম যুক্ত হয়।

এরপর মাসখানেক মতো সামাজিক মাধ্যমে দেখা মেলেনি দুবাইয়ে বড় ব্যবসায়ী বনে যাওয়া আরাভ খানের। তবে গত ৪ মে হঠাৎ ফেসবুক লাইভে এসে আরাভ দাবি করেন, তিনি দুবাইয়ে তিনি ‘ইন্টারপোলের হাতে’ গ্রেপ্তার হয়ে ৩৭ দিন জেল খেটেছেন।

আরাভ খানের এই দাবি যে ভিত্তিহীন সেই কথা বলছে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটের তথ্য। সেখানে বলা আছে, সংস্থাটি কাউকে গ্রেপ্তার করে না। তাদের কোনো কারাগারও নেই।

তাহলে হঠাৎ ফেসবুক লাইভে এসে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খাটার দাবি কেন করলেন আরাভ খান? নতুন করে কী মিশন তার? নানা প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে। তবে উত্তর মিলছে না সহসা। এসব প্রশ্নের নানামুখী উত্তর খুঁজছেন গোয়েন্দারা।

এদিকে আট বছর আগের অস্ত্র মামলায় রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার ১৪ নম্বর মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। মঙ্গলবার বিচারক মুর্শিদ আহাম্মেদ এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

রবিউল ওরফে আরাভের বিরুদ্ধে দেশে পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার বিচারও চলছে। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই রাজধানীর বনানীতে আরাভের অফিসে মামুন ইমরান খানকে হত্যা করা হয়। পরে তার মরদেহ পুড়িয়ে দেয় তারা।

ওই হত্যাকাণ্ডের পলাতক আসামি হওয়ায় দুবাইয়ে স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন আরাভ খান। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, হিরো আলম, চিত্রনায়িকা দীঘিসহ বেশ কয়েকজন দুবাইয়ে আরাভের স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে যান।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ফেসবুক লাইভে এসে আরাভ খান ‘ইন্টারপোলের জেলে’ ছিলেন দাবি করলেও বাস্তবে ইন্টারপোলের গ্রেপ্তার বা কারাবন্দি রাখার ক্ষমতা নেই।

তবু বাংলাদেশের গোয়েন্দারা পুলিশ বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন। তবে এ পর্যন্ত আরাভের গ্রেপ্তার হওয়ার কোনো তথ্য তাদের হাতে আসেনি। ফেসবুকে এসব তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে আরাভ নতুন কোনো মিশনে নেমেছেন বলে ধারণা পর্যালোচনাকারী একাধিক কর্মকর্তার।

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে দুবাই পুলিশকে জানানো হয়েছে। এছাড়া দুবাইয়ে বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কার্যালয়ে যোগাযোগ রাখছে পুলিশ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

আরাভের ভেরিফাউড ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা গেছে, গত ২১ মার্চ একটি পোস্ট দিয়ে সবার কাছে দোয়া চান তিনি। এর পরের পোস্টটি করেন ২১ এপ্রিল, যাতে ঈদ শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে।

এই একমাস বা ৩০ দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিষ্ক্রিয় পাওয়া গেছে। তবে গত ৪ মে আরাভ খান ফেসবুক লাইভে বলেন, তিনি ৩৭ দিন ‘ইন্টারপোলের জেলে’ ছিলেন। সেখানে মাফিয়াদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছে।

এ বিষয়ে জানতে ইন্টারপোলকে তিন দিন আগে ইমেইল পাঠালেও মঙ্গলবার দুপুরে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত উত্তর আসেনি। তবে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে ওয়ান্টেটের তালিকায় রবিউল ইসলাম রবিউল অর্থাৎ আরাভ খানের নাম দেখা গেছে।

আরাভের পাসপোর্টে রবিউল ইসলাম নাম থাকায় ওই নামেই রেড নোটিশ জারি করেছে ইন্টারপোল। সেখানে আরাভ সম্পর্কে তথ্য প্রদানের অনুরোধও জানানো আছে।

ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে এখনও নাম থাকায় আরাভের ‘ইন্টারপোল হেফাজতে’ থাকার দাবি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এছাড়া আরাভকে ফেসবুকে নিষ্ক্রিয় পাওয়া গেছে ৩০ দিন। কিন্তু তিনি এক মাস ৭ দিন বা ৩৭ দিন জেলে থাকার দাবি করেছেন। মিলছে না এ হিসাবও।

এদিকে ইন্টারপোলের হাতে গ্রেপ্তারের তথ্য ছড়িয়ে আরাভ কোনদিক দিয়ে লাভবান হতে চাচ্ছেন? তিনি কী আড়াল করতে চাইছেন? কি উদ্দেশ্য তার? পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই কি আরাভ খান গত ২২ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত কেনো সোস্যাল মিডিয়ায় অনুপস্থিত ছিলেন? গা ঢাকা দিয়েছিলেন? নাকি দুবাই পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গিয়েছিল? এসব প্রশ্ন গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছে খোদ গোয়েন্দাদেরও। চলছে এসবের উত্তর মেলানোর চেষ্টা।

আরাভ ইস্যুটি পুলিশ সদর দপ্তর পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) ডেস্ক আরাভের জেলে থাকার বিষয়ে কোনো তথ্য পায়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।

আর পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মনজুর রহমানও নতুন কোনো তথ্য না থাকার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আরাভকে আইনের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশ পুলিশের এনসিবি শাখা কাজ করছে।’

এদিকে রেড নোটিশ জারি থাকা কোনো অপরাধীকে সরাসরি ইন্টারপোল হেফাজতে নেয় না জানিয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা বলেন, ‘অপরাধীর অবস্থান করা দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় গ্রেপ্তার অভিযান চালিয়ে থাকে ইন্টারপোল। গ্রেপ্তার বা আটকের পর গ্রেপ্তারস্থল দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতেই অপরাধীকে রাখা হয়। এরপর যে দেশের অনুরোধে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে, সেই দেশে অপরাধীকে ফিরিয়ে দিতে আইনি বা গ্রেপ্তারস্থল দেশের আইনে কোনো বাধা না থাকলে অপরাধীকে সংশ্লিষ্ট দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে আরাভ ইন্টারপোলের জেলে থাকার যে তথ্য প্রচার করছে, তার ভিত্তি নেই।’

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি থাকার পর সেই অপরাধীকে সংশ্লিষ্ট দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অপরাধী অবস্থান করা দেশের পলিসির ওপর নির্ভর করে। ইন্টারপোল সংশ্লিষ্ট দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে রেড নোটিশ জারির বিষয়টি জানায়। সেই অপরাধীর ওপর নজর রাখার বিষয়টি অবহিত করে।

এদিকে ‘ভারতীয় পাসপোর্ট’ নিয়ে দুবাইয়ে অবস্থান করা আরাভকে দুবাই পুলিশ ফেরত দেবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ভারতের পাসপোর্টধারী হওয়ায় বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে।

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর