চোখের ইশারায় হচ্ছে হুন্ডি, ডুবছে দেশ

আহাদ সাহেব (ছদ্মনাম) দেশের বাইরে থাকেন ৬ বছর ধরে। সম্প্রতি দেশের বাড়িতে দ্রুত টাকা পাঠানোর দরকার হলে প্রবাস থেকে সদ্য বাংলাদেশে আসা এক বন্ধুকে বলেন, তার পরিবারকে ১০ লাখ টাকা দিতে। সে তাই করে। বিনিময়ে আহাদ সাহেব যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তার সে বন্ধুর পরিবারকে সমমূল্যের ডলার দিয়ে দেন। আপাতদৃষ্টিতে কাজটি খুব সাদামাটা। অনেকেই এতে দোষ খুঁজবেন না। কিন্তু এতে দোষ আছে। কারণ এটিই হচ্ছে হুন্ডি। অবৈধভাবে টাকা লেনদেনের কৌশল। জেনে কিংবা না জেনে দেশের ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে, প্রবাসীরা টাকা পাঠাচ্ছেন বিভিন্ন চ্যানেলে- এতে করে বাড়ছে হুন্ডির আশ্রয়, বাড়ছে না দেশের রিজার্ভ।

হুন্ডিকে তুলনা করা যায় ইন্টারনেটের ‘ডার্ক ওয়েবের’ সাথে। বলা হয়ে থাকে ডার্ক ওয়েব হচ্ছে সমুদ্রে থাকা সেই বরফ খণ্ডের নিমজ্জিত অংশ- ওপর থেকে দেখে মনে হয় একটুখানি, অথচ নিচে তার বিস্তৃতি অতলস্পর্শী। হুন্ডির দশাও অনেকটা এমনিই। ব্যাংকে প্রতিবছর প্রবাসীরা কতোটা অর্থ পাঠাচ্ছে, তার একটি নির্দিষ্ট হিসাব থাকে। কিন্তু প্রতিবছর হুন্ডির মাধ্যমে কত কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, কত টাকা বাজারে আসছে- তার কোনো সঠিক হিসাব থাকে না।

সরকার হুন্ডি বন্ধে নানা পদক্ষেপ নিলেও, চোখের ইশারায় চলা এ অবৈধ মুদ্রা লেনদেন কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। বারবার প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান, অর্থমন্ত্রীর আকুতি- কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন। উপায়ন্তর না দেখে অত্যাচারিত মানুষ যেভাবে বলে- ‘আল্লাহ বিচার করবে’, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল চলতি মাসে সেভাবেই বলেছেন, যারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আনে তারা বিবেকের কাছে দায়ী থাকবেন।

হুন্ডি কেন বন্ধ হচ্ছে না, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মানের সঙ্গে খোলাবাজারে মুদ্রার মানের একটা বড় পার্থক্য থাকে। এতে করে বেশি লাভের আশায় প্রবাসীরা কিংবা যারা দেশে থাকে তারা হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করেন। ব্যাংকের সঙ্গে বাজারের সামঞ্জস্য না থাকলে অবৈধ পথে অর্থ পাঠাতে উৎসাহী হন প্রবাসীরা।

সাবেক গভর্নরের হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বর্তমানে ব্যাংকে প্রতি ডলারের বিনিময়ে টাকার মান ৯৫ টাকার কম-বেশি। একই ডলার কার্ব মার্কেট অর্থাৎ খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১১৩ থেকে ১১৫ টাকায়। অর্থাৎ বৈধ চ্যানেলে ১ হাজার ডলার পাঠালে ব্যাংকে এর মূল্যমান হবে ৯৫ হাজার টাকা (প্রণোদনাসহ প্রায় সাড়ে ৯৭ হাজার টাকা), খোলাবাজারে একই অঙ্কের অর্থের মূল্যমান দাঁড়াবে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা, হুন্ডির মাধ্যমে ক্ষেত্র-বিশেষে তা আরও বেশি। ১ হাজার ডলারে যেখানে টাকার হেরফের প্রায় ২০ হাজার টাকা, সেখানে প্রবাসীদের বৈধপথে লোকসানে টাকা পাঠানোর প্রবণতা কম থাকবে- এটাই স্বাভাবিক।

মূলত হুন্ডি এমন একটি ব্যবসা- যা নিভৃতে কিংবা নিজেদের মধ্যকার চ্যানেলের মধ্যে পরিচালিত হওয়ায়, আইন করে এটি বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। হুন্ডি একেবারে বন্ধ করা না গেলেও কমিয়ে আনতে নেয়া যেতে পারে বেশকিছু কার্যকরী পদক্ষেপ। মুদ্রা বিনিময় হারের সঙ্গে সমন্বয়ের পাশাপাশি সহযোগিতামূলক আচরণ করতে হবে ব্যাংকগুলোকে।

এ ব্যাপারে সানাউল্লাহ নামে একজন প্রবাসী বলেন, ব্যাংকের আচরণ ও সেবা দেয়ার মধ্যে একটি কর্তৃত্বমূলক স্বভাব রয়েছে। এতে করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ব্যাংকভীতি কাজ করে। আপনি ডলার কিনতে কিংবা বিক্রি করতে ব্যাংকে যাবেন- আপনাকে এক গাদা ফরম দেবে পূরণ করা জন্য, নোটারি, সত্যায়ন, জবাবদিহিতা, ভিসা-আমন্ত্রণপত্র, আর নানা কিসিমের প্রশ্ন। এতে করে একবারে শিক্ষা হয়ে যাবে আপনার। অন্যদিকে আপনি খোলাবাজারে কিংবা হুন্ডির মাধ্যমে ডলার কেনা-বেচা করতে যাবেন- কোনো ঝামেলা ছাড়াই কাজ হয়ে যাবে। হুন্ডিতে ডলার কেনা অনেকটা বাজারে গিয়ে পণ্য কেনার মতো। আপনি ঝামেলা এড়াতে সবার আগে ব্যাংকিং রীতিনীতি এড়াতে চাইবেন। এভাবেই ব্যাংকের ওপরে হুন্ডি চ্যানেল কর্তৃত্ব করছে।

কেবল ডলার কেনা-বেচা না, আমদানি-রফতানিতেও রয়েছে কর নীতির নানা ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা। দেশের সাধারণ মানুষ রিজার্ভের মতো ‘সামষ্টিক অর্থনীতি’ নিয়ে যতটা না সচেতন, তার থেকে বেশি ভাবেন নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে এবং এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে জনগণের মনোভাব বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়াটাই কার্যকরী বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বার্তাবাজার/এম আই

বার্তা বাজার .কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
এই বিভাগের আরো খবর